অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন রিচার্ড থ্যালার

মাথাভাঙ্গা মনিটর: অর্থনৈতিক আচরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ রিচার্ড এইচ থ্যালার। এবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোট আটজন মার্কিন গবেষক নোবেল পুরস্কারের সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। গতকাল সোমবার রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি এ পুরস্কার ঘোষণা করে। এবারের নোবেল পুরস্কারে আমেরিকানদের জয়জয়কার। চিকিৎসা ও পদার্থবিজ্ঞানে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখিয়ে ছয়জন মার্কিন বিজ্ঞানী নোবেল জিতে নেন। রসায়ন বিজ্ঞানে এ বছরের নোবেল বিজয়ী তিনজনের মধ্যে একজন ছিলেন মার্কিন। মাঝে শান্তি ও সাহিত্যে কোনো মার্কিনের নাম শোনা না গেলেও অর্থনীতিতে আবারও এক মার্কিনকেই বেছে নিয়েছে নোবেল কমিটি। অর্থনীতি ও মনোবিজ্ঞানের মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধান ঘোচাতে কাজ করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। নোবেল কমিটির ভাষায়, তিনি অর্থনীতিকে অনেক বেশি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন।

অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মনস্তত্ত্বের প্রভাব নিয়ে কাজ করে আগে থেকেই আলোচনায় ছিলেন রিচার্ড থ্যালার। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অর্থনীতিবিদের লেখা নাজ নামের বইটি বোদ্ধা ও সাধারণ পাঠক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক সমাদৃত হয়। বইটিতেই তিনি অর্থনীতির একটি বিশেষ নিয়ন্ত্রক উপাদান হিসেবে নাজিং শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আলতো ছোঁয়া। তিনি মূলত দেখাতে চেয়েছেন, সাধারণ মানুষ তাদের আচরণের মাধ্যমে কীভাবে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তার মতে, সাধারণ মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারলে অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নেয়া সম্ভব। তার এ মতবাদে পরবর্তী সময়ে অনেক গবেষক উদ্দীপ্ত হন। সময়ের সাথে এ মতবাদ এতোটাই প্রভাব বিস্তার করে যে ২০১০ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একটি নাজ ইউনিট স্থাপন করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিলো জনগণের আচরণ পরিবর্তনের উদ্ভাবনী কৌশল খুঁজে বের করা।

নোবেল কমিটির অন্যতম বিচারক পার স্ট্রোমবার্গ বলেন, থ্যালারের গবেষণা অর্থনীতির ওপর সাধারণ মানুষের আচরণ ও মানসিকতার প্রভাবকে সামনে এনেছে। অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্দীপ্ত করার প্রক্রিয়াটিই ছিলো তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র। নোবেল কমিটির দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অর্থনৈতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে থ্যালার মানসিক ও আচরণের বিভিন্ন বাস্তবানুগ অনুমানকে ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন। তিনি এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে হাজির করেন। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তিবোধের সীমাবদ্ধতা, সামাজিক অভিরুচি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ঘাটতি। তার মতে, এসব বিষয় ব্যক্তির সিদ্ধান্ত ও বাজারের কার্যকারিতার ওপর সমন্বিতভাবে প্রভাব ফেলে। যুক্তিবোধের সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যার জন থ্যালার মানসিক হিসাব নামে একটি তত্ত্বকে হাজির করেন। তার মতে, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষ সামগ্রিক ফলাফলের বদলে পৃথক পৃথক ক্ষেত্রের আংশিক ফলাফলকে গুরুত্ব দেয় বেশি। একই পন্থায় কোনো বস্তুর প্রতি মানুষের বেশি যত্নবান হওয়ার বিষয়টিকেও ব্যাখ্যা করা যায়। এক্ষেত্রেও সামগ্রিক চিন্তা না থাকায়, মানুষ নিজের না হলে সাধারণত কোনো বস্তুর প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হয় না। মানুষের বুদ্ধিগত সীমাবদ্ধতার বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে আর্থিক বাজারে। সামাজিক অভিরুচির ক্ষেত্রে থ্যালার হাজির করেন ন্যায্যতার প্রসঙ্গ। পরীক্ষা ও তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি দেখান, উচ্চ চাহিদার সময়ে ভোক্তাদের ন্যায্যতা বিষয়ে সচেতনতা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময় আবার এ সচেতনতা ও এর প্রভাবটি কাজ করে না। তার তৃতীয় নিয়ামক আত্মনিয়ন্ত্রণের ঘাটতি অনেক পুরোনো একটি বিষয় হলেও বাজারব্যবস্থায় এর প্রভাব বিচারের জন্য তিনি এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত প্ল্যানার-ডুয়ার পদ্ধতিটি ব্যবহার করেন। একই সাথে তিনি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও চটজলদি রূপায়ণের মধ্যে বিদ্যমান অন্তর্গত বিরোধের ওপরও আলোকপাত করেন। তিনি দেখান যে এ বিরোধের কারণেই বৃদ্ধ বয়সের জন্য বহু আঁটসাঁট পরিকল্পনা করা হলেও অনেকেরই তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন। তিনি এ ক্ষেত্রে নাজিং শব্দটি ব্যবহার করেন এবং একেই আত্মনিয়ন্ত্রণ স্বল্পতা কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থাপত্র হিসেবে হাজির করেন। তার মতে, উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষের এ আত্মনিয়ন্ত্রণকে উন্নত করা গেলে তা ব্যক্তি থেকে শুরু করে সামগ্রিক অর্থনীতিতেই ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, থ্যালারের গবেষণা অর্থনীতি ও মনোবিজ্ঞানকে যূথবদ্ধ করেছে। যৌক্তিক ও নিয়ন্ত্রিত পন্থায় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থাপত্র দিলেও থ্যালার নিজে তা মানবেন না বলেই জানিয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে ৯০ লাখ ক্রোনা বা ১১ লাখ ডলার হাতে পেলে তিনি তা সর্বোচ্চ অযৌক্তিক পন্থায় ব্যয় করবেন বলে জানিয়েছেন।