সামাজিক ক্ষতি এড়াতে ছড়াতে হবে সচেতনতার আলো

বাল্যবিয়ে মানে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে। এ বয়সে বিয়ের আসনে বসতে বাধ্য করা কিংবা ওতে বসার জন্য নিজেই বাড়ি ছাড়া বড্ড ক্ষতিকর। বিয়েতে বসতে বাধ্য করা মানে নিজের সন্তানকে নিজের হাতে অসহনীয় যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দেয়াই শুধু নয়, উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়া। আর অপ্রাপ্ত বয়সে নিজেই ওই বিয়ের প্রলোভনে পড়া মানে নিজের হাতে নিজের ক্ষতি ডেকে আনা। চরম এই সত্যটা বোঝাতে, অভিভাবকদের উপলব্ধি করাতে দীর্ঘদিন ধরেই নানামুখি কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কারাদ-ও দেয়া হচ্ছে গ্রামবাংলায়। এ খবর প্রায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকার পাতায় উঠে আসছে। এরপরও কেন বাল্যবিয়ে বন্ধ হচ্ছে না? ভবিষ্যত ক্ষতি হতে পারে শঙ্কা মেনেও তথা বাল্যবিয়ের ক্ষতির বিষটি উপলব্ধি করেও অনেক অভিভাবক আছেন যারা বিয়ের আয়োজনের বিকল্প খুঁজে পান না। কারণ বখাটের উৎপাতের পাশাপাশি বড় হতে না হতে তথা অপ্রাপ্ত বয়সেই স্বস্তা গল্পের সিনেমা নাটক দেখে নিজেকে নায়ক, কিংবা নায়েকা ভাবতে শুরু করা।
এক সময় বাল্যবিয়েরই চলন ছিলো। কনের বয়স ৯ হতে না হতে পাত্র খোঁজা হতো। পাত্রের বয়স পনেরো নাকি পঁচিশ সেদিকে যতোটা গুরুত্ব দেয়া না হতো, তার চেয়ে ঢের বেশি করে দেখা হতো জাত-পাত বংশ। তখন বোঝাপড়ায় যে যথেষ্ঠ ঘাটতি ছিলো তা কালক্রমে উপলব্ধি করেছে মানুষ। এই উপলব্ধি বোধে যে এখন পূর্ণতার অভাব তাও স্পষ্ট। যে অভাবটুকু পূরণে সহায়ক হতে পারে যে গণমাধ্যম, সেই গণমাধ্যমগুলোতে সময়ের নির্ঘণ্ট মেনে বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরলেও যেসব গান, নাটক, পূর্ণ বা স্বল্পদৈঘ্য চলচিত্র সম্প্রচার করে তা দেখলে একজন উঠতি বয়সী যুবকের ক্ষেত্রে উত্ত্যক্তকারী হওয়া যেমন অমূলক নয়, তেমনই অপ্রাপ্ত বয়সেই একজন কিশোরীর হোঁচট সম্ভব নয়। অথচ নায়ক, বা নায়েকার চরিত্রটা এমন হওয়া উচিত যে চরিত্র দেখে উদীয়মানদের মধ্যে বড় হওয়ার উদ্দীপনা জাগে। বড় হলে সব কিছুই পাওয়া যায় পছন্দের মতো, কিংবা পছন্দের কাউকে অথবা কিছু পেতে হলে জোরজবরদস্তির গান না গেয়ে নিজেকে যোগ্য করতে হলে সংগ্রামটা কেমন হওয়া দরকার সেটাই দেখানো উচিত। এরকম যে একেবারেই নেই তা নয়, তবে সৃষ্টিশীলতার যে বড্ড অভাব তা অস্বীকার করবেন কীভাবে? অভাব রয়েছে বলেই তো পড়শি দেশের ধারাবাহিকে মত্ত আমাদের অধিকাংশ পরিবারের অন্দর। ওইসব ধারাবাহিকে নাকি পারিবারিক হিংসারও বীজ বোপন করছে। এসব রুখতে হলে ভিনদেশের সংস্কৃতি আসার জানালা বন্ধ করার চেয়ে সুস্থ ধারার নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চায় নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে। তাছাড়া ভালোপাত্র পেয়েছি বলে এ পাত্র আর মিলবে না প্রলোভনে পড়ার রেওয়াজও অভিভাবকদের ত্যাগ করতে হবে। ভালোপাত্রের সন্ধান করার চেয়ে নিজের কনেকে যোগ্য করে তোলার গুরুত্ব দিতে পারলে পরিবেশটাই এক সময় বদলে যাবে। বিশ্বের যাদেরকে আমরা উন্নত বলি, ওরা এভাবেই নিজেদের সফলতা এনেছে।
সমাজে যাদেরকে বখাটে বলা হয় তারও সমাজেরই কারো না কারো সন্তান। তাকে সুপথে রাখার দায় সমাজেরও কম নয়। বাল্যবিয়ে রোধে বখাটেদের উৎপাত রুখতে আইন প্রয়োগের আবশ্যকতা যতোটা তার চেয়ে ওদের সুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠার পরিবেশ গড়ে তোলার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওরাই জাতির ভবিষ্যত। যাদের বখাটে বলা হয়, পশ্চিমাদের ভাষায় ওরা টিনএজার। থার্টিন বা ১৩ থেকে ১৯ নাইনটিন। এ বয়সে ওরা সঠিক নির্দেশনা না পেলে টলে পড়াটাই স্বাভাবিক। সঠিক পথের নির্দেশনা মানে নিশ্চয় অভিভাবক কিংবা স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বা পাড়ার বুড়োদের উপদেশ নয়। যা দেখে, যা শুনে ওদের মানসিকতা সুন্দর হয় তাহলে পরিবার ও সমাজের সাহিত্য-সংস্কৃতি। ওটাই যখন মেরুদ-হীন অবস্থায়, তখন পড়শি দেশের ওই জোর করে প্রস্তাবে রাজি করানোর দৃশ্যের সাথে সাথে ‘হান্ডেড পার্সেন্ট লাভ লাভ…..’ সংস্কৃতিতে উদ্বুব্ধ হওয়াই কি সঙ্গতঃ নয়? উঠতি বয়সীদের সুপথে রাখতে খুলে দিতে হবে বিশুদ্ধ বাতাসের জানালা। সামাজিক ক্ষতি এড়াতে ছড়াতে হবে সচেতনতার আলো।