গাংনীতে দুদকের গণশুনানি ॥ দুর্নীতি বিষয়ে জমজমাট আলোচনা

গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুর গাংনী সন্ধানী মেডিকেল স্কুল মিলনায়তনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানি গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুদক, মেহেরপুর জেলা ও গাংনী উপজেলা প্রশাসন এবং গাংনী উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সরকারি বিভিন্ন দফতরে সেবা গ্রহিতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির বিষয়ে উত্থাপিত ২৭টি অভিযোগ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মনখুলে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করেন। জনসম্মুখে অভিযোগের জবাব ও করণীয় নিয়ে দুদক কমিশনারে নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। জমজমাট আলোচনা-সমালোচনায় মুখরিত অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন বিপুল সংখ্যক দর্শক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ। প্রধান অতিথি ছিলেন দুদক কমিশনার (তদন্ত) এএফএম আমিনুল ইসলাম। অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত দফতরের প্রধানগণকে মঞ্চে ডাকা হয়। অতিথিবৃন্দ ছিলেন দর্শকদের কাতারে। চৌগাছা দারুল ইয়াতিম এতিমখানা পরিচালনা কমিটির সভাপতি নাজমুল হুদা ও সম্পাদক আব্দুল মজিদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠানের নামে উত্তোলিত প্রায় সাত লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করে দুদকে প্রতিবেদন প্রেরণে সমাজসেবা অফিসারকে নির্দেশ দেন দুদক কমিশনার। এ প্রসঙ্গে সমাজসেবা অফিসার বলেন, এ বিষয়ে সোমবার জেলায় উপপরিচালকের কার্যালয়ে উভয়পক্ষকে ডাকা হয়েছে। শুনানি অনুষ্ঠানের বেশির ভাগ সময়জুড়েই ছিলো গাংনী পৌর মেয়রের কয়েকটি অভিযোগ। আলোচিত এসব অভিযোগ উত্থাপন করলে করতালিতে ভূষিত হন তিনি। অভিযোগে মেয়র বলেন, গাংনী পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে ১৩ জন শিক্ষক বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষক আইনের তোয়াক্কা না করে বিদ্যালয়ের গাছ কেটে অর্থ তছরুছ করেছেন।
গাংনী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করে মেয়র বলেন, পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোশাররফ হোসেন ও প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন সম্পর্কে শ্যালক-দুলাভাই। তাদের দুর্নীতির শেষ নেই। ঘুষের বিনিময়ে অনেক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেরই বেতন হচ্ছে না। অপরদিকে গায়ের জোরে কমিটি গঠন হয়। ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানের কমিটি কখনো নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয় না। গোপনে কমিটি করে বোর্ড থেকে অনুমোদন করা হয়। এ দুটি প্রতিষ্ঠান রক্ষায় দুর্নীতিবাজ শিক্ষক ও সভাপতির দৃষ্টান্তমূলক সাজা দাবি করেন তিনি। দুদক কমিশনারের নির্দেশে প্রতিষ্ঠান দুটির অভিযোগের বিষয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মীর হাবিবুল বাসার বলেন, আমাদের কিছুই করার নেই। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যা করার তা বোর্ডের ও মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের। তবে ছাড়া পাচ্ছে না অভিযুক্তরা। প্রতিষ্ঠান দুটির অভিযোগের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে আগামী ১০ দিনের মধ্যে দুদকে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য ইউএন এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশ দেন দুদক কমিশনার। এছাড়াও হাসপাতালের খাবার, চিকিৎসা এবং অপারেশন থিয়েটার চালুর বিষয়ে অভিযোগ করেন মেয়র। অনুষ্ঠানে মেহেরপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতির গাংনী জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারের বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি, টাকা ছাড়া মিটার না পাওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। দ্রুত এগুলো নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়ে দুদকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের জন্য আহ্বান জানান দুদক কমিশনার। সরকারি অন্য দফতরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাশাপাশি এলজিইডি গাংনী অফিসের বিরুদ্ধে ঘুষ-বাণিজ্যের মধ্যদিয়ে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার অভিযোগ ওঠে। জবাবে উপজেলা প্রকৌশলী বলেন, এক ঠিকাদারকে সতর্ক করে পত্রপ্রেরণ করা হয়েছে। তবে তার ব্যাখ্যা যথাপোযুক্ত হয়নি। নিম্নমানের মালামাল দিয়ে কীভাবে রাস্তা নির্মাণ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করেন দুদক কমিশনার। ওই সব রাস্তাঘাটের নিম্নমানের মালামাল দ্রুত সরিয়ে নেয়ার জন্য এলজিইডি গাংনী প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেন দুদক কমিশনার। এছাড়াও এলজিইডির দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকে লিখিত অভিযোগ উত্থাপনের আহ্বান জানায় দুদক।
এদিকে ঘুষের বিনিময়ে উপজেলা সঞ্চয় অফিসার প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকদের করেসপন্ডিং স্কেল দিয়েছেন। বর্তমানে তারা খুব ঝামেলায় রয়েছেন অভিযোগ করে অনেকটাই বেকায়দায় পড়েন গাংনী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভেজ সাজ্জাদ রাজা। বিদ্যালয়ের জায়গায় অবৈধ দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দেয়ার অভিযোগ উত্থাপন হয় পারভেজ সাজ্জাদ রাজার বিরুদ্ধে। দুদক কমিশনার তাকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ঘুষ দেয়া ও নেয়া সমান অপরাধ। আপনার কেন ঘুষ দিয়ে স্কেল নিলেন? আপনাদের বিরুদ্ধেও তো ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার? এ বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য দুদক কুষ্টিয়া কার্যালয়কে নির্দেশ দেন দুদক কমিশনার। এছাড়াও সাবরেজিস্ট্রি অফিসসহ বিভিন্ন দফতরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় দুদক কমিশনার বলেন, এর আমরা যে মামলাগুলো করেছি তার ৩৭ ভাগ সাজা হয়েছে। পরবর্তীতে সমস্যা চিহ্নিত করে মামলা পরিচালনা করায় সাজার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ ভাগ। আমরা চেষ্টা করছি শতভাগ অভিযোগ ও মামলার সাজা নিশ্চিত করা হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি আরো বলেন, দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য দিলে দুদকের কাজ করতে সহজ হয়। কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে বিব্রত করতে নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তা দুদককে জানাতে সকলের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি। এ বিষয়ে দুদুকের হটলাইন ১০৬ নম্বরে অফিস সময়ে ফোন করার অনুরোধ জানান। বিনা খরচে ওই নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে। অভিযোগ উত্থাপনের পর নিজ নিজ দফতরের প্রধানগণ জনসম্মুখে তার ব্যাখ্যা ও সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। অপরদিকে গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে দুদকে সরাসরি অভিযোগ করার আহ্বান জানান দুদক কমিশনার।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন দুদক খুলনা বিভাগীয় পরিচালক ড. আবুল হাসান, পরিচালক (প্রতিরোধ) মনিরুজ্জামান ও কুষ্টিয়া সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুল গাফফার। উপস্থিত ছিলেন গাংনী উপজেলার সরকারি সকল দফতর প্রধানহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফ-উজ-জামান। উপস্থিত ছিলেন গাংনী উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি সভাপতি আবু জাফর, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামরুল হাসানসহ আয়োজক কমিটির প্রতিনিধিবৃন্দ।