রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বে বাংলাদেশকে দুষছে মিয়ানমার

সেনা নির্যাতন চলছেই, অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা

স্টাফ রিপোর্টার: রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্ব হওয়ার পেছনে উল্টো বাংলাদেশকে দুষছে মিয়ানমার। দেশটির দাবি রাখাইন প্রদেশ থেকে যে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা গত দুমাসে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে এসেছে, তাদের ফেরানোর প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জন্যই দেরি হচ্ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের এমন অবস্থানের মধ্যেও বন্ধ হয়নি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। রাখাইনের বুচিডং এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে মিয়ানমার সেনা ও উগ্রপন্থিরা হানা দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তারা রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা শনাক্তকরণ কার্ড (এনভিসি) ধরিয়ে দিচ্ছে-যেখানে তাদের পরিচয় হিসেবে বলা হচ্ছে বাঙালি। কোনো রোহিঙ্গা কার্ড নিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের সেনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। যে কারণে সেখানে বসবাসরত অবশিষ্ট রোহিঙ্গারাও এদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এরকম হাজার হাজার রোহিঙ্গা উখিয়া সীমান্তের ওপারে অনুপ্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে।

বিবিসির তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, মিয়ানমার এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকলেও ফেরানোর শর্ত কী হবে তা নিয়ে বাংলাদেশ টালবাহানা করছে। মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি-র মুখপাত্র জ তেয এএফপি-কে বলেছেন, ‘আমাদের সরকার অনেক আগেই ঘোষণা করেছে আমরা (এই শরণার্থীদের) যে কোনো সময় ফেরত নিতে রাজি। কিন্তু এটা নিয়ে দুদেশের মধ্যে কী সমঝোতা হবে বাংলাদেশ এখনও সেটাই ভেবে চলেছে।’

গত ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইনের যে শরণার্থীরা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন, তাদের কোনো তালিকাও ঢাকা এখনও তাদের দেয়নি বলে ওই মুখপাত্র জানিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ রাজি হচ্ছে না বলেই শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরানোর প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে।

‘আমরা চাই ১৯৯০’র দশকের গোড়ার দিকে যে ধরনের সমঝোতার আওতায় শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরানো হয়েছিলো এখনও সেই একই ধাঁচের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হোক। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও সেই সমঝোতার শর্তগুলো মানতেই প্রস্তুত নয়’ বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন ওই মুখপাত্র।

এমন কী, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশ সারাবিশ্ব থেকে যে বিপুল পরিমাণ ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে, সে জন্যই তাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ ঢিলেমি করছে বলেও তিনি দাবি করেছেন। ‘এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ সারাবিশ্ব থেকে ৪০ কোটি ডলারেরও বেশি আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। আমরা তো ভয় পাচ্ছি, যেভাবে তারা এই বিপুল পরিমাণ সহায়তা পাচ্ছে তাতে না শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের পুরো প্রক্রিয়াটাই পিছিয়ে যায়’ রয়টার্সকে বলেছেন জ তেয। তিনি বলেন, যেভাবে বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক ভর্তুকি পাচ্ছে তারা, তাতে হয়তো বাংলাদেশ ভাবছে আদৌ শরণার্থীদের তারা প্রত্যাবাসন করবে কি না – আমাদের এখন এটাই দুশ্চিন্তা।

বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে, মানবিক কারণে আপাতত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হলেও তাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই; সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত।

আমাদের উখিয়া সংবাদদাতা রফিক উদ্দিন বাবুল জানান, উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তের ওপারে মেদি এবং লম্বাবিলের ওপারে কোয়াংছিবন সীমান্তে হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। এদিকে উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পলিথিনের ঝুপড়িতে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ঠাণ্ডায় কষ্ট পাচ্ছে। বৃষ্টির কারণে অনেকের ঘরে চুলা জ্বলেনি। কুতুপালং কমিউনিটি সেন্টারে দায়িত্বরত চিকিত্সক অজিত বড়ুয়া জানান, বৃষ্টি ও ঠাণ্ডাজনিত রোগে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক শিশুকে চিকিত্সা দেয়া হয়েছে।

এছাড়াও কুতুপালং, বালুখালী, ময়নারঘোনা, হাকিমপাড়া, তাজনিমারখোলা, শফিউল্লাহকাটা ঘুরে দেখা যায়, সদ্য অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা মসজিদ, মাদরাসা, স্কুলের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে।

রোহিঙ্গা নেতা ডা. জাফর আলম জানান, মিয়ানমারের বুচিডং এলাকার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে উগ্র মগ জনগোষ্ঠী ও সশস্ত্র মিয়ানমার সেনা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের শাদা কার্ড নেয়ার জন্য জোরজবরদস্তি করছে। এসব কার্ড গ্রহণ না করায় সেনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা এদেশে চলে আসার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রায় ৩ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নাফ-নদী পার হয়ে উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়ায় ঢুকে পড়েছে। আশ্রয় নিয়েছে বেড়িবাধ ও মত্স্য ঘেরের বিভিন্ন স্থানে। এদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু। এ ব্যাপারে ৩৪ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর ইকবাল আহমেদ জানান, প্রায় ৩ হাজারের মতো রোহিঙ্গা নো ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে।