জেল হত্যা দিবস আজ

স্টাফ রিপোর্টার: আজ সেই ভয়াল-বীভৎস্য ৩ নভেম্বর। বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের আরেক ভয়ঙ্কর দিন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বেদনাবিধুর কলঙ্কিত দিন। রক্তক্ষরা জেলহত্যা দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশের যেকটি দিন চিরকাল কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, তার একটি ৩ নভেম্বর। যে কটি ঘটনা বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত অর্জনের পথে বাধা তৈরি করেছে, তার মধ্যে একটি ঘটেছিলো ১৯৭৫ সালের এ দিনে।

বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে ৪২ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ জাতির চার সূর্যসন্তান, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ও জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ-ঘনিষ্ঠ সহচর বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সিপাহসালার তাজউদ্দীন আহমেদ কারান্তরীণ অবস্থায় বুঝতে পেরেছিলেন ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর মতো তাদেরও বাঁচতে দেবে না। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর জেলহত্যার কদিন আগে অর্থাৎ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান তার পরিবারের সদস্যরা। তাদেরকে তাজউদ্দীন আহমেদ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদেরকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না। আমি মুজিব ভাইকে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) স্বপ্নে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন- তাজউদ্দীন তুমি চলে এসো, সেই ১৯৪৪ সাল থেকে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়। তারপর থেকে আমরা দু’জন এক সঙ্গে ছিলাম, এখন তোমাকে ছাড়া আর ভালো লাগে না।’ ‘আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমেদ’ গ্রন্থেও এই বিষয়টি লিখেছেন তার কন্যা সিমিন হোসেন রিমি এমপি।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে স্বপ্ন দেখার বিষয়টি যে এত তাড়াতাড়ি তার সামনে এমন নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর হয়ে আসবে, তা বোধহয় তিনি কখনও কল্পনাও করতে পারেননি। অথচ তার স্বপ্নই সত্য হলো। স্বপ্ন দেখার মাত্র ক’দিনের মাথায় জেলখানায় ঘটে যায় ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও কাপুরুষোচিত হত্যাকা-। জাতীয় অপর তিন নেতার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমেদও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

এর আগে একই বছরের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয়েছিলো। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু, পাল্টা ক্যু’র রক্তাক্ত অধ্যায়ে মানবতার শত্রু ও বঙ্গবন্ধুর হন্তারক ওই একই পরাজিত শক্তির দোসর বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে। সেই থেকে প্রতি বছরের মতো এ দিনটি জেলহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সেদিন কারান্তরীণ দেশমাতৃকার সেরা সন্তান এই জাতীয় চার নেতাকে শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাপুরুষের মতো গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে একাত্তরের পরাজয়ের জ্বালা মিটিয়েছিলো। বাঙালিকে পিছিয়ে দিয়েছিলো প্রগতি-সমৃদ্ধির অগ্রমিছিল থেকে। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকা- ছিলো একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। বিশ্বাসঘাতক খুনীদের পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য আজ জাতির সামনে পরিষ্কার। মিথ্যা কুয়াশার ধূম্রজাল ছিন্ন করে আজ নতুন সূর্যের আলোকের মতো প্রকাশিত হয়েছে সত্য।

আসলে হত্যাকারীরা এবং তাদের দোসররা চেয়েছিলো পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে নিক্ষেপ করতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিকতার পথ থেকে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে বিচ্যুত করা এবং বাংলাদেশের মধ্য থেকে একটি মিনি পাকিস্তান সৃষ্টি করা। এখানেই শেষ হয়নি স্বাধীনতার শত্রুদের ষড়যন্ত্র। ৭৫’র পর থেকে বছরের পর বছর বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা চলেছে। বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলব হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জড়িত থাকার প্রমাণ আত্মস্বীকৃত ঘাতকদের মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে।

জেল হত্যাকাণ্ডের পর ওই সময়ই লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে। এরপর দীর্ঘ ৮ বছরেরও বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করে। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তার শাস্তি এবং অপর ৫ জনকে খালাস দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং অপর ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো দফাদার মারফত আলী শাহ, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান ও এলডি দফাদার মো. আবুল হাসেম মৃধা। যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় তারা হলো- কর্নেল (অব) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব) সৈয়দ শাহরিয়ার রশীদ, মেজর (অব) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ (বরখাস্ত), লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব) এমএইচএম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, লে. কর্নেল (অব) এএম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হোসেন এবং ক্যাপ্টেন (অব) নাজমুল হোসেন আনসার। খালাসপ্রাপ্তরা হলো বিএনপি নেতা মরহুম কে এম ওবায়দুর রহমান, জাতীয় পার্টি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক মন্ত্রী মরহুম তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নুরুর ইসলাম মঞ্জুর এবং মেজর (অব) খায়রুজ্জামান।

২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে কেবল রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মো. আবুল হাসেম মৃধা এবং যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত অপর চার আসামি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ওই চার আসামির চারটি আপীল ও রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ রায় দেয়।

তবে জেল হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ সময় পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় নেতার পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন মহল থেকে ওই সময়ই রায়টিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘প্রহসনের রায়’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। একই সঙ্গে রায়টি প্রত্যাখ্যানও করা হয়। তাদের অভিযোগ, জেল হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি। জাতির ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত ও পুনঃবিচার দাবি করেন তারা।

অবশ্য জেলহত্যা মামলায় খালাস পেলেও লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ- এই চারজন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি এদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে পলাতক অপর আট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি সম্পর্কে কোনো মতামত না দেয়ায় তাদের দণ্ড বহাল আছে বলে আইনজীবীরা ব্যাখ্যা দেন।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ায় জেল হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচারের সুযোগ আসে। ২০১২ সালের ১ নভেম্বর সরকারপক্ষ জেলহত্যা মামলার আপীল বিষয়ে সারসংক্ষেপ সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগে জমা দিলে পুনর্বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল আপীল বিভাগের চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ত রায়ে ২০০৮ সালের হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ২০০৪ সালের নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখা হয়। অর্থাৎ পলাতক তিন আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মো. আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। সুদীর্ঘ বছর পর বাঙালি জাতি পায় কাঙ্ক্ষিত বিচার। জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে চার জাতীয় নেতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বাঙালি জাতির ইতিহাসে জাতীয় চার নেতার অবদান চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুজিবনগর সরকার গঠন, রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও দেশবাসীর সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদানের জন্য জাতি তাদের চিরদিন স্মরণ করবে।