বাবাকে মারছ কেন’- বলার পরই শিশু নুসরাতকে খুন করে সাবলেট শাহীন

স্টাফ রিপোর্টার: সাবলেট প্রেমিক শাহীন মল্লিককে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলে আরজিনা বেগম। সংসার গড়ারও স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বামী শেখ জামাল। শেষটায় তাকে চিরতরে সরিয়ে দেবার জন্য প্রেমিকের সঙ্গে পরামর্শ করে। তারই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রাতে জামাল শেখকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে শাহীন। কিন্তু হত্যার দৃশ্য দেখে ফেলে মেয়ে নুসরাত। সে তখন চিৎকার করে বলতে থাকে বাবাকে মারছ কেন- জানতে চায় এবং চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকে। আর হত্যার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাবে এ আশঙ্কায় শাহীন নুসরাতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এতে তার মা আরজিনা বেগমের সম্মতি ছিলো।

গতকাল শনিবার এভাবেই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিলেন নুসরাতের মা আরজিনা বেগম। জবানবন্দি প্রদান শেষে আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে আরজিনা বেগমের প্রেমিক শাহীন মল্লিলকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য বাড্ডা থানা পুলিশ শনিবার ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।

বাড্ডা থানার অফিসার ইনচার্জ জানান, গতকাল শনিবার বিকেলে আরজিনা বেগম ও তার প্রেমিক শাহীন মল্লিককে ঢাকা মুখ্যমহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ সময় আরজিনা জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরী তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। অপরদিকে শাহীনের বিরুদ্ধে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এদিকে শনিবার সকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ বলেন, আরজিনা বেগম ও জামিল ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাড্ডায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। একই বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন শাহীন। ওই বাড়ির প্রথম তলায় থাকতো আরজিনারা। আর তৃতীয় তলায় থাকতেন শাহীন ও তার স্ত্রী মাসুমা।

মাসুমা সারাদিন অন্যের বাসায় কাজ করতেন। জামিল ছিলেন ড্রাইভার। আরজিনা বেগম ও শাহীন দু’জনই সারা দিন বাসায় থাকতেন। সে সুযোগে তাদের মধ্যে নানা কারণে নৈকট্য হয়। শাহীন বিভিন্নভাবে প্রশংসা করায় তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে আরজিনা। কয়েকদিন পর ওই বাড়ি ছেড়ে জামিল ও আরজিনা ময়নারবাগের ৩০৬ নম্বর বাড়ির ছাদে ৭ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নেয়।

নতুন বাসায় এসেও শাহীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন আরজিনা। নিয়মিত তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। শাহীনকে কাছে পেতে নতুন কৌশল অবলম্বন করেন আরজিনা। সংসারের খরচ কমানোর কথা বলে শাহীনের পরিবারকে সাবলেট দেয়ার পরামর্শ দেন স্বামী জামিলকে। পূর্বপরিচিত হওয়ায় শাহীন ও তার স্ত্রীকে ৩ হাজার টাকায় সাবলেট দেন জামিল।

নতুন বাসায় এসে আরজিনা ও শাহীনের সম্পর্ক আরও গভীর হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে আরজিনা জামিলকে তালাক দিয়ে শাহীনের কাছে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে শাহীন তাকে তালাক না দেয়ার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে দুইজন মিলে জামিলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

ঘটনার দিন বুধবার রাতে একই বিছানায় ঘুমান জামিল, আরজিনা, নুসরাত ও তার ছোট ভাই। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আরজিনা ঘরের দরজা খুলে রেখে ঘুমান। পরে শাহীন বাড়ির নিচ থেকে একটি কাঠের টুকরা নিয়ে ঘরে ঢুকে জামিলের মাথায় আঘাত করেন। প্রথম আঘাতের পর জামিল উঠে যায় এবং জিজ্ঞেস করে কেন তাকে আঘাত করা হল। এরপর শাহীন কোনো কথা না বলে আরও কয়েকবার আঘাত করে তাকে হত্যা করেন।

এ সময় ঘুম থেকে জেগে যায় মেয়ে নুসরাত। সে শাহীনের কাছে বাবাকে কেন হত্যা করা হলো জানতে চায় এবং চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকে। তখন নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন শাহীন। তবে প্রথমবার  এতে আরজিনা সম্মতি দেননি। পরবর্তীতে বিপদে পড়ার আশঙ্কায় মেয়েকে হত্যার সম্মতি দেন আরজিনা। এরপর নুসরাতকে বিছানায় গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করেন শাহীন। তখন নুসরাত চিৎকার করায় মুখে বালিশ চাপা দিয়ে তাকে মেরে ফেলা হয়।

এরপর শাহিন তার স্ত্রীকে নিয়ে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে বলে, ঘটনা একটা ঘটে গেছে। এখানে থাকা যাবে না। ভোরে বাড়ির গেট খুললে স্ত্রী মাসুমাকে নিয়ে চলে যায় শাহিন। শাহিনের কাছে আরজিনা নিজের গহনা দিয়ে দেয়। আর বাসায় স্বামী ও মেয়ের লাশ নিয়ে ডাকাতির নাটক সাজায়। সে বাসার সিঁড়ির সামনে বসে থাকে। ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় ওই বাড়ির এক লোক আরজিনাকে দেখে যায়। নামাজ পড়ে ফেরার সময়ও একই জায়গায় আরজিনাকে দেখতে পেয়ে, তিনি তার স্ত্রীকে খোঁজ নিতে বলেন। তখন প্রতিবেশী সবাই জেনে যায় এই হত্যাকাণ্ডের কথা। ডিসি জানান, এ ঘটনায় তদন্তে আশপাশের অনেকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা শিশুও কিছু তথ্য দিয়েছে। সব মিলে এ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই দুইজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড আবেদন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার দিকে ঢাকার উত্তর বাড্ডার ময়নারবাগের ৩০৬ পাঠানভিলার তৃতীয় তলায় ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় বাবা জামিল শেখ (৩৮) ও মেয়ে নুসরাত জাহানের মরদেহ। নিহত জামিলের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের করপাড়া ইউনিয়নের বনপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম বেলায়েত শেখ। তিনি তেজগাঁওয়ে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক ছিলেন। পাঠান ভিলার তৃতীয় তলায় দুই কক্ষ ভাড়া নিয়ে পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। গত কোরবানির ঈদের পর স্ত্রী আরজিনা (৩০), মেয়ে নুসরাত (৭) ও ছেলে আলফিকে (৫) নিয়ে ওই বাসায় উঠেন জামিল।