কারো সন্তানের জন্য অন্তহীন আকুতি কেউ ফেলছে ছুড়ে

সত্যিই বিচিত্র এই জগৎ। নিঃসন্তান দম্পতি সন্তান পাওয়ার আশায় কতো কিছুই না করছে। স্বামী-স্ত্রীর কারো অক্ষমতার বিষয়টি নিশ্চিত হলে অন্যের সন্তান নিজের মতো করে পাওয়ার আশায়ও প্রহর গুণছে বহু দম্পতি। অপরদিকে কোনো কোনো সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তান ফেলে নিজের বা নিজেদের আড়াল করতেও ব্যস্ত অনেকে। সন্তান সে তো সন্তানই। যদিও স্থান কাল পাত্র ভেদে সমাজের দৃষ্টিতে দোষ আড়ালের কারণেই সন্তানকে অস্বীকার করার পথে হাঁটে বহু গর্ভধারিনী। যা একটি অন্যায়কে আড়াল করতে আরেকটি বড় ধরনের অপরাধ করা। বিষয়টি অমানবিকও বটে।
গতকাল পত্রিকায় পাশাপাশি প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনের একটি ছিলো ‘ঠিকানা পেলো হাসপাতালে ফেলে যাওয়া নবাজতক।’ অপরটি ‘সদ্যভূমিষ্ঠ নবজাতকের মৃতদেহ উদ্ধার।’ প্রতিবেদন দুটিই স্পর্শকাতর। যদিও নবজাতকের মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনা সমাজে এখন অনেকটাই গা সওয়া। তবে হাসপাতালে ফেলে যাওয়া কন্যা নবজাতককে পাওয়ার আশায় তিন দম্পতির আবেদন এবং তাদের আকুতি অবশ্যই হৃদয়স্পর্শী। আদালতের বিজ্ঞ বিচারক যখন আবেদনের শুনানি গ্রহণ করেন তখন আদালত প্রাঙ্গণে নেমে আসে স্তবদ্ধতা। নিঃসন্তান দম্পতিগুলোর আবেদন কোনটি ফেলে কোনটি গ্রহণ করবেন? তবুও এক দম্পতিকেই তো দিতে হবে। শুানানি এবং পেশকৃত প্রমাণপত্র পর্যালোচনা করে বিজ্ঞ বিচারক যে দম্পতির পাওয়া উচিত বলে মনে করেছেন, সেই দম্পতিকেই দিয়েছেন। অন্যদেরও আবেদন-আকুতি অসম্মানের নয়। শুনানি শেষে বিজ্ঞ বিচারকের বিচক্ষণ উপলব্ধি- ‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ!’ যে দম্পতি নবজাতককে পেলো ওই দম্পতি আগলে রাখুক তাকে।
এমন সন্তান না আসুক যাকে কোলে তুলে নেয়ার বদলে ছুড়ে ফেলে দিতে হয়। সন্তান যেভাবেই আসুক, ভূমিষ্ঠ হোক- তাকে ফেলে দেয়া, মেরে ফেলা অবশ্যই গুরুতর অপরাধ। একটি অপরাধকে আড়াল করতে আরেকটি অপরাধ করার মধ্যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে না। যার সাথে যে সম্পর্কেরই ফসল হোক, তা অস্বীকার করার মধ্যে শুধু হীনমানসিকতাই লুকিয়ে থাকে না, কাপুরুষত্বেরও প্রকাশ মেলে। যদিও চরম সত্যকে মিথ্যার আবরণে আড়ালের সুযোগ কেউ কেউ নেয় বলেই অন্যরাও সে পথে হাঁটে। তা না হলে কি একের পর এক নবজাতকের লাশ, একের পর এক নবজাতক যেখানে সেখানে ফেলে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। অপরদিকে নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান পাওয়ার আশা পূরণে বিজ্ঞান এখন অনেকটাই সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ। পড়শি দেশেও বিশেষ পদ্ধতিতে একের সন্তান অন্যের গর্ভে আসার পর তা সুহালে ভূমিষ্ঠেরও প্রচলন রয়েছে। যা ভালো-মন্দ খতিয়ে দেখার অবকাশ রাখে।
জগতের শ্রেষ্ঠ সুন্দরের মধ্যে সবকিছুর শীর্ষে নিশ্চয় নবজাতকের মুখ। শিশুর মিষ্টি মুখের হাসি। ধরিত্রীর বুকে ভূমিষ্ঠ প্রত্যেক নবজাতকই নিশ্চয় সুন্দরেরই বার্তাবাহক। কে কোথায় কার কোলে জন্ম নিলো তা দেখার চেয়ে তার কর্মফলই ধর্তব্য বিষয়। নবজাতকের তো কোনো অন্যায় থাকে না। কোনো মা-বাবা সন্তানকে অস্বীকার করলে তার দায় ওই মা-বাবারই ওপরে বর্তায়। নবজাতকের নয়। ফলে প্রত্যেক শিশুর প্রতি আমাদের সকলেরই কর্তব্যপরায়ণ হওয়া দরকার। হাসপাতালে ফেলে যাওয়া নবজাতকের প্রতি শুরু থেকেই কর্তব্যপরায়ণের নজির মিলেছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে নিশ্চয়। কেননা, সদ্যভূমিষ্ঠ নবজাতককে ফেলে রেখে প্রসূতি ও তার সাথে থাকা দু’নারী সরে পড়লেও সেবিকা তুলে নেন কোলে। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার জানার পর তিনি পুলিশকে জানানোর পাশাপাশি নবজাতকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। পুলিশ সমাজসেবা প্রবেশন অফিসারকে অবহিত করে আইনগত পদক্ষেপ নেয়।
না, আর কোনো নবজাতককে ভূমিষ্ঠ হয়েই যেন অবহেলা কিংবা নৃশংসতার শিকার না হতে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সহজাত প্রবৃত্তি যখন অস্বীকার করা যায় না, তখন তারই ফসলকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সামাজিক বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে যে বা যারা অন্যায়ে মাতে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। নবজাতক হত্যা করে কিংবা ফেলে দিয়ে অপরাধ আড়ালের সুযোগ পেলে অভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। ফলে পরিস্থিতি বেসামাল হওয়ার আগেই সতর্ক হতে হবে আরও।