রংপুরে পুলিশ-মুসল্লি সংঘর্ষে নিহত ২ আহত ৩০

ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি

স্টাফ রিপোর্টার: ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগ তুলে গতকাল শুক্রবার রংপুরের গঙ্গাচড়ার হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামে পুড়িয়ে দেয়া হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি। রংপুরে পুলিশ ও মুসল্লিদের সংঘর্ষে দু’জন নিহত হয়েছেন। এ সময় আরও ৩০ জন আহত হন। ফেসবুকে ইসলামধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার দুপুরে মুসল্লিরা সমাবেশ করার পর হিন্দুপাড়ায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে পুলিশ বাধা দিলে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের শলেয়া শাহ বাজারে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী ঠাকুরপাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের ১২টি বাড়ি ভাংচুর ও একটি শিবমন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। এ সময় ওসব বাড়িতে লুটপাটও করা হয়। জুমার নামাজ শেষে এলাকার ১০টি মসজিদ থেকে মুসল্লিদের ঠাকুরপাড়া গ্রামে মানববন্ধন ও সমাবেশের ডাক দিলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাশের আটটি গ্রামের ১০ হাজারের অধিক মুসল্লি ঠাকুরপাড়া গ্রামে সমাবেশে যোগ দেয়। সমাবেশ চলাকালে একটি মহল হঠাৎ উত্তেজনা ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তারা একটি শিবমন্দিরে আগুন ধরিয়ে দিলে তা ভস্মীভূত হয়। এ সময় খগেন চন্দ্র রায়, খিরোদ চন্দ্র রায়, সুধীর চন্দ্র রায়, অমূল্য রায়, বিধান রায়, বিপুল রায়, কৌশল্লা, সুধীর মহন্তসহ ১২টি বাড়িতে হামলা করে ভাংচুর করা হয়। এ সময় নূপুর রায়ের একটি গুদাম ঘরসহ প্রায় ২৫টি বাড়িতে লুটপাট করা হয়। পরে হামলাকারীরা রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে অবস্থান নেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে তারা পুলিশের ওপর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালান। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অর্ধশতাধিক টিয়ার শেল ও ৩০ রাউন্ড রাবার বুলেট ছোড়ে। সংঘর্ষের সময় হাবিবুর রহমান (২৬) ও সিএনজি চালক হামিদুল ইসলাম (৩০) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পুলিশসহ ৩০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন (২৫), মাহবুল ইসলাম (৩০), রিপন ইসলাম (২৫), আমিনুল ইসলাম (৩৫), শাহজাহান মিয়াসহ (৪৫) ছয়জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। বাকিরা পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিকেলে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এ সংঘর্ষ চলে। পুলিশ এলাকা ঘিরে রেখেছে।

জানা যায়, রংপুরের পাগলাপীর শলেয়া শাহ এলাকার খগেন চন্দ্র রায়ের ছেলে টিটুল চন্দ্র রায় (৪০) রোববার ইসলাম ধর্ম ও নবীকে নিয়ে ‘ফেসবুকে’ কটূক্তি করে প্রচার চালায়। এ নিয়ে এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের মাঝে ক্ষোভ দেখা দেয়। এ নিয়ে সোমবার মামলা করা হয়। টিটুলকে গ্রেফতারে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু টিটুল গ্রেফতার না হওয়ায় এলাকায় এ নিয়ে উত্তেজনা চলতে থাকে। এ নিয়ে উস্কানি না দেয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে তিন দিন ধরে প্রচার চালানো হয়। কিন্তু একটি মহল ধর্মীয় উস্কানি ছড়িয়ে গ্রামবাসীর উত্তেজিত করে। কয়েকদিন ধরে তারা বিভিন্ন মসজিদে বৈঠক করে ধর্মীয় ‘সেন্টিমেন্ট’ কাজে লাগিয়ে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে প্রচার চালিয়ে আসছিলো। গতকাল জুমার নামাজ শেষে এ ঘটনার প্রতিবাদে এলাকার ১০টি মসজিদে মুসল্লিদের ঠাকুরপাড়া গ্রামে মানববন্ধন ও সমাবেশের ডাক দেন।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, এদের মধ্যে মাহাবুবুল (২৫), জামিল (২৬), হাবিবুর রহমান (৩০), আলিম (৩২), জাহাঙ্গীর (২৮), আমিন (২৬) ও রিপনের (২৮) অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের পেটে ও মাথায় বুলেটবিদ্ধ হয়েছে। অন্যদের পায়ে ও হাতে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়। চিকিত্সাধীন অবস্থায় সন্ধ্যায় মারা যান হাবিবুর রহমান। তিনি শলেয়াশাহ এলাকার একরামুল হকের ছেলে বলে হাসপাতালের ভর্তি রেজিস্টারে উল্লেখ রয়েছে।  বিপুলসংখ্যক ছররাগুলি ও রাবার বুলেট ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ।  আহত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে তিন জনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন এসআই সেলিম মিয়া, কনসটেবল নাসির হোসেন, রফিকুল ইসলাম। রাত সাড়ে ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ঘটনাস্থল রংপুর মহানগরীর পাগলাপীর ও গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া এলাকায় তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। সেখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। জুম্মার নামাজের পর গতকাল দুপুর দুইটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে হামলাকারীরা। এ সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

গতকাল রাতে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধ চক্র সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু রাফা মো. আরিফকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল-এ) সাইফুর রহমান এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এতো অল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ এক হয়ে সহিংস ঘটনা ঘটানোয় আমরা এটিকে পরিকল্পিত বলে মনে করছি।’ কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি হাসানুজ্জামান হাসু শাহ্ অভিযোগ করেন, গত মঙ্গলবার ওই ইউনিয়নের টিটু রায় নামে এক যুবকের ফেসবুকে হযরত মুহম্মদ (সা.) কে নিয়ে কথিত কটূক্তির প্রতিবাদে এলাকাবাসী মানববন্ধন করে। এ ঘটনাকে পুঁজি করে জামায়াত ইসলামের নেতাকর্মীরা গত কয়েকদিন থেকে রংপুরের গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ, নীলফামারী জেলার কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন মসজিদে প্রচার চালিয়ে দলীয় নেতাকর্মীসহ মুসল্লিদের উত্তেজিত করে তোলে। গতকাল জুমার নামাজের পর জামায়াত-শিবিরের কয়েক হাজার নেতাকর্মী সংঘবদ্ধ হয়ে পাগলাপীল এলাকায় পরিকল্পিতভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। পরে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় সেখানকার দুটি মন্দিরে আগুন দেয় তারা এবং মন্দিরের মাইকসহ অন্যান্য জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। এর মধ্যে একটি মন্দির আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়। এ সময় হামলাকারীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৫-২০টি বাড়ির গরু-ছাগল, হাস-মুরগি লুটপাট করে নেয়াসহ তাদের ধান, গোলা ঘর, খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, টিটু রায়ের ৩টি ঘর ছাড়াও সুধীর রায়ের ৬টি ঘর, অমূল্য রায়ের দুটি ঘর, বিধান রায়ের দুটি ঘর, কৌশল্ল রায়ের দুটি, কুলীন রায়ের একটি, দীনেশ রায়ের একটি, ক্ষীরোদ রায়ের একটি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

গঙ্গাচড়া থানার ওসি (তদন্ত) নজরুল ইসলাম গতকাল রাতে জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানা যায় জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা সংঘব্ধ হয়ে এই নাশকতা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনি জানান, ৮-১০টি বাড়ির ২০টি ঘরে আগুন দেয়া হলে সেগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়া আরো প্রায় ১৫-২০ বাড়ির গরু-ছাগল, হাস-মুরগি লুটপাটসহ তাদের ধান, গোলাঘর, খড়ের গাদায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। খগেন রায়ের পুত্র টিটু ৮ বছর থেকে নারায়ণগঞ্জে চাকরি করেন। ধারণা করা হচ্ছে তার মোবাইলফোন থেকেই ধর্মীয় উস্কানি দেয়া হয়েছে।

অপরদিকে টিটু রায়ের ভাই বিপুল রায় বলেন, ‘আমার ভাই অশিক্ষিত। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় কবিরাজি করে বেড়ায়। সে ফেসবুক তেমন চালাতে পারে না। টিটু ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দেয়নি। কে বা কারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে তার ফেসবুকে পরিকল্পিভাবে হযরত মুহম্মদ (সা.) কে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দেয়।’ টিটু রায়ের মা জিতেনবালা বলেন, ‘কেন আমাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হলো আমরা জানি না।’

গঙ্গাচড়া থানার ওসি জিন্নাত আলী জানান, উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের লাল চান্দুপুর গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে টিটু রায়কে আসামি করে গত ৫ নভেম্বর গঙ্গাচড়া থানায় মামলা করেন। টিটু রায় নারাগঞ্জের ফতুল্লায় দুই স্ত্রী-সন্তান বাস করেন। তিনি আরো জানান, টিটু রায়ের বাড়িসহ ওই এলাকার দিয়ে ৮/১০টি বাড়ির ২০ ঘরে আগুন দেয়া হলে সেগুলো ভস্মীভূত হয়ে যায়।

এই স্ট্যাটাসের জের ধরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে এই সংঘবদ্ধ চক্র হাজার হাজার জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী গতাকল শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর এক জোট হয়ে পাগলাপীর বাজারে মানববন্ধন শুরু করেন। এক পর্যায়ে এই সংঘবদ্ধ চক্র গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত ঠাকুরপাড়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এতে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে রংপুর কোতয়ালী থানা, পুলিশ লাইন, গঙ্গাচড়া ও তারাগঞ্জ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল-এ) সাইফুর রহমান জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাজ করছে। এ ঘটনার পর পাগলাপীর ও এর আশপাশের গ্রামগুলো পুরুষশুন্য হয়ে পড়েছে।