বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ঐক্য অটুট থাক

দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নানা আলোচনার জন্ম দিয়ে মেয়াদ শেষের তিন মাস আগেই বিদায় নিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার পর, গত কয়েকদিন ধরেই তার পদত্যাগের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছিলো। অবশেষে শনিবার দুপুরে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ২১ জন প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করলেও পদত্যাগের ঘটনা এটাই প্রথম। এ পর্যন্ত যেসব প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন, তার মধ্যে বিচারপতি সিনহাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি অমুসলিম। ফলে রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের একটির প্রধান ব্যক্তির এই পদত্যাগ ৪৭ বছরের বাংলাদেশকে নতুন একটি অভিজ্ঞতার মুখে দাঁড় করালো এমনটি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পড়েন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উত্থাপিত হয়। অভিযোগ ওঠে রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নে তিনি প্রলুব্ধ হয়েছেন বলে। এছাড়া প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেয়ার আগেই যুদ্ধাপরাধের একটি মামলার শুনানিতে একাত্তরে নিজের শান্তি কমিটির সদস্য থাকার কথা তুলে ধরে সর্বপ্রথম আলোচনায় আসেন তিনি। আর প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়ে বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ নানা সময় তুলে ধরে আলোচনার জন্ম দেন। নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন নিয়েও তার সাথে সরকারের বিরোধ আলোচনায় আসে। অন্যদিকে অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সহকর্মী বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সাথে তার বাদানুবাদ বিচারাঙ্গন ছাড়িয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়ায়। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য স্থাপন নিয়েও সরকারের সাথে টানাপড়েনের বিষয়টি আলোচিত। তবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণে সংসদ, সরকার এবং জাতির জনককে খাটো করা হয়েছে অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগের দাবি তোলে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। এ সময় বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির মতামতের পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া হয়। অবশেষে নানা নাটকীয়তার মধ্যে ৩৯ দিন ছুটি নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ায় বড় মেয়ের কাছে যান বিচারপতি সিনহা। আর ১১ নভেম্বর তার পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত হলো। ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার আগে বিচারপতি সিনহা বলেছিলেন, ক্ষমতাসীনদের আচরণে তিনি বিব্রত, শঙ্কিত। ফলে সরকারের সাথে বিরোধের জেরেই যে তিনি পদত্যাগ করেছেন, এ বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে।

স্মর্তব্য যে, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার উদ্দেশ্য ছিলো আদালতের কর্তৃত্ব শক্তিশালী করা। ফলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা পার্লামেন্টকে দিয়ে করা সংবিধানের সংশোধনী তিনি বাতিল করে দেন। আর সংশোধনী বাতিলের নির্দেশের ফলে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফাটল ধরাবে এমন আশঙ্কাও প্রতিভাত হয়। যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমীচীন নয় বলেই বিশেষজ্ঞদের মতামত রয়েছে। সংসদ আইন প্রণয়নকারী এবং বিচার বিভাগ আইনের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে তাতে গোটা জাতি বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। বিষয়টির সাথে রাজনৈতিক কূটকৌশলও যুক্ত হওয়া সঙ্গত নয়। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিবাদ-বাদানুবাদ দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার পরিপন্থী। এজন্য উভয় প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরতদের বক্তব্য বিবৃতি দেয়ার সময় আরও সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে এমন কোনো বক্তব্য প্রদান বা সিদ্ধান্ত নেয়া যৌক্তিক হতে পারে না, যাতে রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও শৃঙ্খলার স্বার্থে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যেমন বিকল্প নেই, তেমনিভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এ দুটি প্রতিষ্ঠানেরই ভূমিকাই প্রধান। বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে কোনো কারণেই যাতে ঐক্যের ব্যত্যয় না ঘটে, এ ব্যাপারে সংশিস্নষ্টরা সজাগ ও সতর্ক থাকবে এটাই প্রত্যাশা।