বোর্ডের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে

জোট সরকারের সময় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো। ফল প্রকাশে বিলম্ব, বছরের অর্ধেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও পাঠ্য বই না পাওয়া, পাঠ ও পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে দিকনির্দেশনা না থাকা প্রভৃতি কারণে ওই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো।২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় গিয়ে এ দশার অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেয়। তাতে ফলও পাওয়া গেছে। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকার পরও কিছু বিষয়ে অগ্রগতি লক্ষণীয়। পাঠ্য বই সরবরাহের প্রক্রিয়াকে আরো গতিশীল করতে পারলে এবং যথাসময়ে পাঠ ও পরীক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অবহিত করতে পারলে ফল আরো ভালো হতো।

সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ থাকার পরও সাফল্য পূর্ণমাত্রায় অর্জন করা যাচ্ছে না বেশ কিছু কারণে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্য বই প্রণয়ন ও মুদ্রণপ্রক্রিয়ায় গলদ রয়ে গেছে। প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে, যেমন পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে কমিটি গঠন, লেখক দলে সদস্য নিয়োগ, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, ভ্রমসংশোধক (প্রুফ রিডার) নিয়োগ, সম্পাদনা ও লেখা পরিবর্তন-পরিমার্জনে অনিয়ম ঘটছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাঠ্য বই মুদ্রণে অনিয়ম সবচেয়ে বেশি হচ্ছে।

বিএসটিআইয়ের সনদবিহীন কাগজ ও নিম্নমানের কালি ব্যবহার করে বই ছাপা হলেও ‘সন্তোষজনক’ উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে। পাঠ্য বই প্রণয়নপ্রক্রিয়া অস্বচ্ছ এবং রাজনৈতিক প্রভাবদুষ্ট। পাঠ্য বই লেখার মতো ‘বিশেষায়িত’ বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের পাঠ্য বই প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। সম্প্রতি একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর আবদারে পাঠ্য বই পরিবর্তন-সংশোধন করেছে এনসিটিবি। এই পরিবর্তন-সংশোধনের অনেক কিছুই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও মৌলিক চেতনার বিরোধী। পাঠ্য বই ছাপার দরপত্র ডাকায়ও অনিয়ম করা হয়। পছন্দের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে আগেই দর জানিয়ে দিয়ে আর্থিক সুবিধা নেয়া হয়। একই ব্যক্তির একাধিক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়।

এনসিটিবির বিভিন্ন কমিটিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা বা বাদ দেয়া হয়। এক বিষয়ের বিশেষজ্ঞকে অন্য বিষয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। সম্পাদনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অফিস সময়ে নিজস্ব কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ফলে সম্পাদনায় মন দিতে পারেন না। লেখকদের অজ্ঞাতে পাঠ্য বইয়ে লেখা সংযোজন বা বিয়োজন করা হয়। পাঠ্য বই সংক্রান্ত অনিয়মের এসব তথ্য মোটেও সুখকর নয়। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে এনসিটিবি অনিয়মমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলার উপযোগী হয়। বোর্ড পরিচালনার বিধিমালা এখনো জারি করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মৌখিক ও তাত্ক্ষণিক নির্দেশে চালানো হচ্ছে। বিধিমালা জরুরি ভিত্তিতে জারি করা দরকার। পাঠক্রম ও পাঠ্য বই প্রণয়ন কমিটিতে যোগ্যদের নিয়োগ দিতে হবে। সর্বোপরি বোর্ডের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে সরকারের উদ্যোগের সুফল মিলবে না।