বোরোর পর এবার আমন সংগ্রহ অভিযানও ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা

সরকার নির্ধারিত ধানের মূল্যের চাইতে চালের বাজার চড়া

 

স্টাফ রিপোর্টার: সরকার নির্ধারিত ধানের মূল্যের সাথে বর্তমান বাজারে বিক্রিত চালের দরের বিশাল ফারাক থাকায় বোরোর পর এবার আমন সংগ্রহ অভিযানও ব্যর্থ হওয়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ফের হুমকির মুখে পড়বে। পাশাপাশি ভর মরসুমেও চালের দর আগের মতোই চড়া থাকবে বলে বাজারসংশ্লিষ্ট অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

তারা জানান, গত ১২ নভেম্বর খাদ্য অধিদফদর প্রতি টন ধানের মূল্য ২৬ হাজার ৬৭ টাকা ৫৬ পয়সা ঘোষণা করেছে। অথচ টিসিবির মূল্যতালিকা অনুযায়ী ওইদিন বাজারে মোটা চাল (স্বর্ণা-চায়না ইরি) প্রতি কেজি ৪২ থেকে ৪৬ টাকা, পাইজাম-লতা ৫২ থেকে ৫৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা, নাজির-মিনিকেট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং সরম্ন চাল ৫৮ টাকা ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

মিল মালিকরা জানান, এক মণ ধানে সর্বোচ্চ ২৭ কেজি চাল পাওয়া যায়। সে হিসেবে সরকার নির্ধারিত ধানের দর অনুযায়ী প্রতি কেজি চালের দাম হবে ৩৮ টাকা। অথচ বাজারে এ দামে সর্বনিম্নমানের চালও নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই কৃষকরা কেউ সরকারের কাছে ধান বিক্রির চিন্তা করছে না।

চাতাল মালিক, মিলার ও কৃষকদের দাবি, বর্তমানে চালের উচ্চমূল্য এবং বাজারে ধানের দর পর্যালোচনা না করেই সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করেছে। একই কারণে বোরো সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হলেও এ ইস্যুতে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও সরকার বিবেচনায় নেয়নি। এতে স্বাভাবিকভাবেই দেশকে আবারও আমদানিনির্ভর হতে হবে বলে মনে করেন তারা।

তাদের আশঙ্কার যথার্থতা মেনে নিয়ে জেলা খাদ্য কর্মকর্তারা বলেন, বোরো ধানের চেয়ে মাত্র ২ টাকা বাড়িয়ে গত ১২ নভেম্বর সরকার ধানের দাম কেজি প্রতি ২৬ টাকা ৬ পয়সা নির্ধারণ করলেও তা যৌক্তিক হয়নি। কেননা বাজারে চালের দর এখনো অনেক চড়া। এছাড়া নানা প্রতিবন্ধকতায় কৃষকদের প্রতি কেজি ধান উৎপাদন করতে প্রায় ২৫ টাকা খরচ হয়েছে। এ বাস্তবায়তায় বোরোর মতো আমনের সংগ্রহ টার্গেটও ব্যর্থ হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন মাঠপর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তারা।

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বোরো মরসুমে সারাদেশে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান সংগ্রহ করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলো সরকার। কিন্তু অধিকাংশ জেলাতে নির্ধারিত টার্গেট পূরণ হয়নি। এমনকি বেশকিছু জেলায় এ কর্মসূচি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে কোনো মিলমালিকও সরকারের সাথে চাল সরবরাহের চুক্তিও করেনি। আবার বেশকিছু মিলমালিক চুক্তি করলেও চাল দেয়নি।

খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বোরোতে ১৫ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও পৌনে তিন লাখ টন সংগ্রহ করাই সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ৭ লাখ টন ধানের টার্গেটের বিপরীতে সংগ্রহ করা হয়েছে ২ হাজার টনের কিছু বেশি। যা লক্ষ্যমাত্রার দশমিক ২৫ শতাংশ। আর আট লাখ টনের বিপরীতে আড়াই লাখ টনের কিছু বেশি চাল সরকারি গুদামে মজুদ করা সম্ভব হয়েছে।

চাতালমালিকরা জানান, ধানের দাম নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়ায় বোরোর মতো আমন সংগ্রহ অভিযানও পুরোপুরি ব্যর্থ হবে। মিলারদের ভাষ্য, সাধারণ যাচাইবাছাই করে কৃষকদের কাছ থেকে ২৫ থেকে ২৬ টাকায় ধান কিনতে হয়। অথচ সরকারি গুদামে চাল দিতে গেলে তারা নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা গ্রহণ করে। এছাড়া অনেক সময় কৃষকদের পরিবহন খরচও দিতে হয়। সবমিলিয়ে বেচাকেনার দর একই এসে দাঁড়ায়। অথচ এর মাঝে ধান সিদ্ধ, ভাঙানি এবং শুকানোর খরচ রয়েছে। তাই কৃষকরা হাটে নতুন আমন ধান বিক্রি শুরু করলেও তা সরকারি গুদামে যাচ্ছে না। বরং তা মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের খাতায় জমা হচ্ছে। তারা মিলারদের সাথে আগাম চুক্তি করে তা কিনে নিয়ে নিজস্ব গুদামে মজুদের ছক আঁটায় বাজারে চালের দর চড়া-ই রয়ে গেছে।

এদিকে সরকারের সাথে ধান-চাল সরবরাহের চুক্তি না করায় সারাদেশে বিপুলসংখ্যক মিলমালিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হলেও সার্বিকভাবে এতে কোনো লাভ হবে না বলে মনে করেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, লাভ না করে কিংবা লোকশান দিয়ে কেউ ব্যবসা করবে না। তাই সরকারি গুদামে ধান-চালের মজুদ বাড়াতে হলে সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে এর দর নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে আগামী দিনে এ কর্মসূচিতে আরও বড় ব্যর্থতা দেখা দেবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চালকল মালিক সমিতির একজন নেতা বলেন, ‘আমরা লাভের জন্য ব্যবসা করি, লোকসানের জন্য নয়। চাল না দেয়ায় অনেক মিলমালিককে তিন বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাতে তারা উল্টো খুশিই হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কালো তালিকাভুক্ত না করে বরং ধান-চালের যথার্থ দাম নির্ধারণ করতে পারলেই এ সমস্যার সমাধান হবে। তা না হলে আগামীতে এ সংকট আরও বাড়বে।’ সরকারের মজুদের স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা চালের মজুদের পাহাড় গড়ে দাম আরও বাড়াবে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ওই মিলমালিক নেতা।

তবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কথা স্বীকার করলেও দেশে খাদ্য সংকট হবে না বলে দাবি করেন। তিনি জানান, চলতি অর্থবছরে বিদেশ থেকে ১৫ লাখ টন চাল এবং ৫ লাখ টন গম আমদানি করা হবে। এতে খাদ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। যদিও আমন সংগ্রহ সফল হবে কি-না সে সম্পর্কে মন্ত্রী কোনো মন্তব্য করেননি।

একই সুরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংগ্রহ ও সরবরাহ) মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘যেটুকু সংগ্রহ হয়েছে এরপর আর বোরো সংগ্রহ নিয়ে আমরা ভাবছি না। কারণ হাওরে বোরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বোরো উৎপাদন হয়নি। আমরা চাল আমদানি করে মজুদ বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছি।’

এদিকে বাজার সংশিস্নষ্টরা বলছেন, যে ছক এঁটে দেশের চাল সংকট মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তা অনেকটাই অযৌক্তিক। এতে চাহিদা অনুযায়ী জোগান থাকলেও বাজারদর অস্বাভাবিক থাকবে। কেনোনা মধ্যস্বত্বভোগীরাই লাভের একটি বড় অংশ তাদের পকেটে ভরবে।

এডিবির গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে তারা জানান, ধান থেকে চাল উৎপাদন এবং সে চাল ভোক্তার কাছে পৌঁছুনোর আগে পাঁচ ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীর হাত ঘুরে আসে। এসব মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে যায় চালের দামের ৪০ শতাংশ।

বাজার পর্যবেক্ষকরা বলেন, এবার যেখানে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ করতে হয়েছে ২৩ থেকে ২৫ টাকা; সেখানে সেই ধান ২৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হলে কৃষকের মাথায় হাত পড়বে। কেননা বর্তমান বাজারে চড়া দরে চাল বিক্রি হচ্ছে। এ হিসেবে ধান থেকে চাল উৎপাদন ও বিপণনের প্রক্রিয়ায় দামের বড় অংশই মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে ঢোকানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

চালের বাজার নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ‘দ্য ট্রান্সফরমিং অব রাইস ভ্যালু চেইন ইন বাংলাদেশ অ্যাণ্ড ইণ্ডিয়া: ইমপ্লিকেশন ফর ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ধান-চালের দাম নির্ধারণে মধ্যস্বত্বভোগীদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ফলে দেশের ধান উৎপাদনে নিয়োজিত কৃষকরা যেমন ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত, তেমনি বেশি দামে চাল কিনে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা করছেন অতিমাত্রায়।

গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, কৃষকরা দীর্ঘ সময় বিনিয়োগ করেও প্রতি কেজি ধানে ১-২ টাকার বেশি মুনাফা করতে পারেন না। দাম নির্ধারণে অক্ষমতার কারণে অনেক সময় তারা বড় ধরনের লোকসানেও পড়েন। অন্যদিকে ধান থেকে চাল রূপান্তর প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যবসায়ী ও মিলাররা সেই ধান কেনেন কৃষকের বিক্রি দামের চেয়ে দেড় গুণ বেশি টাকা দিয়ে। এতে মিলারদের ধান সংগ্রহ প্রক্রিয়াতেও ধানের দামের ৫০ শতাংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে। কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি ২৪ টাকা দামে ধান কিনে তার সাথে আরো ৫০ শতাংশ খরচ যোগ করেও চালকল মালিকদের মুনাফা করা সম্ভব। সে হিসেবে মিলারের যৌক্তিক মুনাফাসহ প্রতি কেজি চালের দাম ৪০ টাকার মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু সেই চাল বাজারে এখনো চড়া দরে বিক্রি হচ্ছে। যা মধ্যস্বত্বভোগীরাই নির্ধারণ করেছেন। এখানে কৃষক কিংবা ভোক্তার কোনো হাত নেই।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটোরাইস ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির নেতারা বলেন, তারা সরকার নির্ধারিত দামেই ধান কিনেন। তবে তা সরাসরি আড়তদারদের কাছে চাল বিক্রি করেন না। এখানে মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়া আছে। তারাই ট্রাক ভাড়াসহ আনুসঙ্গিক খরচের দোহাই দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। অথচ সব দোষ পড়ে মিলারদের ঘাড়ে।