কিচিরমিচির

নদীর গল্প
-আব্দুস সালাম
রাইসা তার মা-বাবার কাছ থেকে নদ-নদী নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প শুনেছে। আবার পাঠ্যবইয়েও সুন্দর সুন্দর নদ-নদীর চিত্র দেখেছে। সে গল্প শুনেছে, ‘মাছেরা নদীতে বাস করে। নদীতে সাঁতার কাটে। মনের আনন্দে পানির মধ্যে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। জেলেরা নদীতে জাল ফেলে সেসব মাছগুলো ধরে।’ সে আরও শুনেছে, ‘নদীতে বড় বড় পালতোলা নৌকা চলে। বড় বড় নদীতে লঞ্চ ও স্টিমারও চলে। নদীর দুই পাড়ে কাশফুলের সারি দেখা যায়। সেগুলো দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। নদীর পাড়ে যাদের বাসস্থান তারা খুব সুখে-শান্তিতে বাস করে। সবসময় তারা সুশীতল বাতাস গায়ে মাখে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সঙ্গে নদীতে নেমে স্নান করে, ডুব দেয়, সাঁতার কাঁটে। আবার বিকালবেলায় সকলে একত্রে নদীর ধারে খেলাধুলা করে। মাছ ধরে। নদীর তীর থেকে শামুক-ঝিনুক কুড়ায়। তারা বিভিন্নভাবে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করে।’ রাইসাদের বাড়ি দরবেশপুর গ্রামে। ওই গ্রামে কোনো নদ-নদী নেই। তাই সে বাস্তবে কখনও নদী দেখেনি। অথচ তার মনের মধ্যে নানান রকমের নদীর চিত্র অঙ্কিত। সে অনেকদিন ধরে বাবার নিকট আবদার করছে- তাকে নদী দেখাতে হবে। মেয়ের আবদার রক্ষার্থে বাবা বেশ কয়েকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু সময়ের অভাবে নিয়ে যেতে পারেননি। আজ বাবার মনটা বেশ ভালো। রাতেরবেলায় একত্রে খেতে বসেছেন। খেতে খেতে বাবা রাইসাকে বললেন, আগামীকাল তোমাকে মাথাভাঙ্গা নদী দেখাতে চুয়াডাঙ্গাতে নিয়ে যাবো। বাবার কথা শুনে রাইসার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। অনেকদিন পর এবার বুঝি তার নদী দেখার সাধটা পূরণ হবে। রাতের খাবার খেয়ে সে দাঁত ব্রাশ করে। তারপর স্কুলের পড়া তৈরি করার জন্য আবার পড়তে বসে। পড়ালেখা শেষ করে সে মায়ের সঙ্গে ঘুমাতে যায়।
মাথাভাঙ্গা নদী নিয়ে রাইসা রাতেরবেলায় স্বপ্ন দেখে। সে দেখে নদীর ঘাটে সারি সারি নাও। কোনোটি আবার পালতুলে দূরে কোথাও এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি লঞ্চ স্টিমার এপার ওপার করছে। বাবা একটা নৌকা ভাড়া করে তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছেন। ঢেউয়ের তালে তালে নৌকাটি চলতে থাকে। বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। শীতল বাতাস তার শরীরে কাঁপন ধরায়। নদীর দুই পাড়ে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি আর ফড়িং ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। এমনসময় হঠাৎ তার নজরে পড়ে নৌকার চারিপাশে ছোট-বড় অনেকগুলো মাছ। মাছগুলো সাঁতার কেটে তাদের সাথে সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা রঙিন মাছ তার নজরে পড়ে। সে খুশি হয়ে মাছটিকে যেই ধরতে যায় আর অমনি নৌকার পাটাতন থেকে পানিতে পড়ে যায়। সে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকার শুনে মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। গায়ে হাত দিয়ে তিনি রাইসাকে জাগিয়ে দেন। রাইসা ঘুম থেকে জেগে সব ঘটনা খুলে বলে। মা সবকথা শুনে তাকে সান্ত¦না দিয়ে বলেন- তুমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলে। এখন ঘুমাও। সকালবেলায় তোমার বাবা তোমাকে নদী দেখাতে নিয়ে যাবেন। রাইসা আবার মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরেরদিন বাবা সড়কপথে বাসে করে রাইসাকে চুয়াডাঙ্গাতে নিয়ে যায়। মাথাভাঙ্গা নদীর ওপর বড় একটি সেতু। বাসটা সেখানে পৌঁছালে বাবা রাইসাকে নিয়ে নেমে পড়েন। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে বাবা রাইসাকে নদীটা দেখিয়ে বলেন- এটাই হলো মাথাভাঙ্গা নদী। এটির উৎপত্তি হয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলার জলাঙ্গির উৎস থেকে আনুমানিক ১৬ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে পদ্মা নদী হতে। নদীটি উৎপত্তিস্থল হতে কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলা পেরিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার হাওলি ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে ইছামতি-কালিন্দী নদীতে গিয়ে পড়েছে। বাবার কথা শুনে ব্যথিতচিত্তে অপলক দৃষ্টিতে রাইসা নদীটা দেখতে থাকে। বইয়ে পড়া নদীর সঙ্গে বাস্তবে দেখা নদীর তুলনা করতে থাকে। সে নদীর চারিদিকটা আগ্রহভরে অবলোকন করে। কিন্তু তার মনের মুকুরে অঙ্কিত নদীর সঙ্গে বাস্তব নদীর কোনো মিল খুঁজে পায় না। সে দেখে নদীতে কোনো পানি নেই। নেই কোনো ঢেউ। নেই নদীর বুকে ভাসমান সারি সারি নৌকা বা লঞ্চ-স্টিমার। সে দেখে হেঁটে হেঁটে নদীটা অনেকেই পার হচ্ছে। নদীর পাড়ে সে খুঁজে পায় না ফুলে-ফলে ভর্তি সবুজ গাছপালা যেখানে প্রজাপতি, ফড়িংদের মেলা বসে। এর পরিবর্তে তার নজরে পড়ে নদীর বুকে জেগে ওঠা চর যেখানে কৃষকেরা চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত। নদীর পাড়ে যেসব ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে তার টয়লেটগুলো নদীর কোলঘেষেই নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ যা প্রতিনিয়ত নদীর পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এসব দেখে সে ভীষণ অবাক হয়। সে ক্লান্ত কণ্ঠে বাবাকে জিজ্ঞাসা করে- এটা কি বইয়ে পড়া সে রকম কোনো নদী?
: হ্যাঁ মা। তুমি বইয়ে যেসব নদীর কথা পড়েছো এটা সে রকমই একটি নদী।
রাইসা তার বাবার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। সে তার মনকে প্রশ্ন করছে- একটা সরু খালকে বাবা কেনো নদী বলছে? নদীর বর্ণনার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তাহলে…? রাইসা নদীর এই ভগ্নদশা দেখে ব্যথিত হয়। নদীতে ঢেউ না থাকলেও রাইসার বুকে কষ্টের ঢেউ ওঠে। তাহলে কি নদীগুলো মরে যাবে? রাইসার এমন হাজারো প্রশ্ন নীরবে অশ্রু হয়ে মিশতে থাকে মাথাভাঙা নদীর পানিতে।

শীত
-সা’দ সাইফ
শীত, শীত আহা শীত
শীত মানে ঠান্ডা,
শীত মানে কেঁপে ওঠে
গরীবের জানটা।

শীত,শীত আহা শীত
শীত মানে রস,
শীত মানে পিঠাপুলির
দারুণ হরষ।

শীত, শীত আহা শীত
শীত মানে নের,
শীত মানে চারপাশে
কুয়াশার ঘের।

 

শীতটা যেনো আসছে তেড়ে
-রুহুল আমিন রাকিব
শীত পড়েছে ঘরে বাইরে
একটু রোদ কোথায় পাইরে।
সূর্যি মামা দিল আঁড়ি
পড়ছে গায়ে সাদা শাড়ি।
ঘাসের ডগায় শিশির কণা
কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমায় মনা।
কোমল রোদটা মিষ্টি ভারি
খেঁজুর রসে ভরছে হাড়ি।
পায়রা গুলো মনের সুখে
দিচ্ছে খাবার ছানার মুখে।
চলছে কৃষাণ মাঠের পানে
ভরছে গোলা নতুন ধানে।
শীতটা যেনো আসছে তেড়ে
হেমন্তেরই খোলস ছেড়ে।

 

নবান্নের দেশে
-মকবুল হামিদ
মনটা আমার যাচ্ছে চলে
নবান্নের ঐ দেশে,
সেথায় যাবো একলা মনে
মুক্ত পাখি ভেসে।

নতুন ধানের পায়েস খাবো
সবাই মিলে মিশে,
এমন মজার আয়োজন আর
পাবো বলো কিসে?

পাকা ধানের শিষরা দোলে
একটু বাতাস পেলে,
হাওয়ার তালে সারাটাক্ষণ
মনের মত খেলে।

নবান্নটা নিয়ে এলো
খেঁজুর রসের হাঁড়ি,
কোনো দিনো যাবো না ভাই
এমন দেশটা ছাড়ি।

 

প্রাণ ফিরে পায়
-শরীফ সাথী
শীত সকালে সূর্য মামার মুখ,
ভালবেসে মিষ্টি হেসে
পূব আকাশে উঠলে ভেসে
ঠান্ডা দিনে গরম পাওয়ার সুখ।
কুয়াশাভর শিশিরের গায়
রোদের আভা এলে,
সবুজ পাতা সতেজ হতে
ধরে পাখা মেলে।
পুষ্পরা সব ঘ্রাণ দিয়ে যায়,
পশুপাখি প্রাণ ফিরে পায়।

 

আমার দেশ
-মোঃ মাসুদ পারভেজ
আজও আমি শুনিনি ভাই,
আছে এমন আরেক দেশ-
প্রকৃতি যার পটে আঁকা,
লাগে দারুণ, দারুণ বেশ।
এই দেশটি সবুজ শ্যমল ছায়ায় ঘেরা
খাল নদী বিল মাছে ভরা
শিশিরসিক্ত ঘাসের উপর
শিউলি ফুলের নিরব ঝরা।
উঠান পরে আমের ডালে
সকাল সন্ধা নিয়ম মেনে-
কিচিরমিচির পাখির ডাকা।
লক্ষ্মী বৌয়ের কুরআন শুনে
আলসেমি, ঘুম ঝেড়ে ফেলে
ভোরের বেলা চাষীর জাগা।
চোখ জুড়ানো ধানের-শীষে,
আনন্দ আর হাসি মিশে-
নতুন সপ্নের ছবি আঁকা।
ছয় ঋতুর রূপের মেলায়
বসন্ত আর শীতের সাথে
নানান উৎসবে মিশে যাওয়া।
দূর আকাশের তারার সাথে,
মনের যতো চাওয়া গুলো
মনের ভুলেই বলে ফেলা।
জ্যোছনা রাতের মৃদু আলোয়
লেখাপড়া চুলোই দিয়ে-
খোকা খুকির হাসির খেলা।
এমন দেশটি খুঁজে ফিরে
পাবেনা জানি কোথাও যে আর
বাংলার মতো আর কোনো দেশ
পাওয়া হবে ভীষণ যে ভার।

 

হেমন্তে
-আকলিমা খাতুন
হেমন্ত এলো সবার মাঝে,
হিমেল পরশ নিয়ে।
পাকা ধানের মধুর গন্ধে,
সবার মন মাতিয়ে।

নবান্নেরই জাগলো সাড়া,
মুখর হলো সারা পাড়া।
ভাঁপা পুলি দুধের পিঠা,
খেঁজুর রসে দারুন মিঠা।

শিঁশির ভেজা ভোর বেলা,
সূর্যি মামা দেয় দোলা।
ঘাসের ডগায় শিশির কণা,
ছড়িয়ে আছে মুক্ত দানা।

কুয়াশার চাদর দিয়ে মুড়ি,
ধীর পায়ে আসছে শীত বুড়ি।
দিচ্ছে হানা দ্বারে দ্বারে,
রাত শেষে কাক ডাকা ভোরে।

গরীবের দুঃখ হয়ে,
শীত আসছে ভয়ে ভয়ে।
পোষাকের অভাব বড়,
থাকবে শীতে জড়ো সড়ো।

হেমন্তকে বিদায় দিয়ে,
হালকা শীতের পরশ নিয়ে।
খেঁজুর গুড়ের সুঘ্রানে,
মাতলো হাওয়া অঘ্রানে।

 

বৃষ্টি চাই
-লাবিবা আস সাদিয়া
আকাশ আকাশ ডাকপাড়ি,
বৃষ্টি এসো তাড়াতাড়ি।
দুপুরবেলায় রোদ বেড়েছে,
পিপাসাও খুব পেয়েছে।

দুষ্টুমিতে তুমি আকাশ,
কষ্ট দিচ্ছ না দিয়ে বাতাস।
আমি জানি তুমি ভালো,
আর করোনা মুখটি কালো।

ডেকে ডেকে হাপিয়ে গিয়ে
সরিয়ে নিলাম দৃষ্টি,
তাই দেখে আকাশ থেকে
পড়লো ঝুম বৃষ্টি।

 

শীত পড়েছে
-পলক রায়
শীত পড়েছে আমার গাঁয়ে
নানান পিঠার ধুম
শীতের পিঠার প্রেমে পড়ে
নেইতো চোখে ঘুম।

শীত পড়েছে ফুল ফসলে
সতেজ তাজা ফুল
শীতের মিষ্টি রোদ পোহাতে
হয়না কারো ভুল।

শীত পড়েছে মাঠেঘাটে
দূর্বাঘাসের শীষে
পাখি ডাকা শীতের ঋতু
আসে বাংলাদেশে।

শীত পড়েছে সূর্যটাও তাই
ওঠতে দেরি করে
শীতটা আসুক নব্যরূপে
আনন্দে যাক ভরে।

 

হেমন্তের সকাল
-শচীন্দ্র নাথ গাইন
রোদ চিকচিক শিশির কণা
মুক্তা হয়ে হাসে ,
ঘোমটা খুলে তাকায় ভোরে
দুর্বা কোমল ঘাসে ।

পূবের আকাশ ফর্সা হলে
সূয্যিটা দেয় উঁকি ,
শিউলি তলায় ফুল কুড়োতে
মাতলো খোকা-খুকি।

বিল-ঝিল-খাল মুখর রাখে
পাখ-পাখালির গীতে,
মৃদু হাওয়ায় শরীর জুড়োয়
হালকা ছোঁয়া শীতে ।

মিষ্টি রসের হাড়ির ওপর
মৌমাছি যায় উড়ে,
গুনগুনানি ছন্দ সুরের
সারা বাতাস জুড়ে ।

সোনার বরণ রবির কিরণ
দেয় নির্মল আলো,
হেমন্তের এই সকালটা তাই
সবাই বাসে ভালো।

 

শীতের ছোঁয়া
-সালমা আজাদ
এই তো সেদিন ঝরলে তুমি
বৃষ্টি অঝর ধারায়
হাসছো তুমি খানিক বাদেই
নাচছো হিমেল হাওয়ায়।।

মেজাজ তোমার এলোমেলো
যায় না বোঝা মর্জি
ভ্যাবসা গরম, একটু শীতে
দুলছে বাবুই দর্জি।

হালকা শীতে পাতলা চাদর
লাগলো গায়ে কাঁপন
রসনা-বিলাস পিঠা পায়েস
শিশির হলো আপন।

সূর্যকিরণ হালকা যতই
বাড়ছে শীতের রেশ
আলসেমীটা শীতের চাদর
আরাম আরাম বেশ।

সাতসকালে শীতের ছোঁয়া
মায়ের ডাকে ভোর
ধোঁয়া ওঠা ভাপা খাবি
খোল না, খোকা দোর।