পোপের কাছে রাখাইনে শান্তিরক্ষী চাইলেন রোহিঙ্গারা

স্টাফ রিপোর্টার: হত্যা-ধর্ষণ-নিপীড়নের ভয়ঙ্কর বয়ান পোপ ফ্রান্সিসকে শোনালেন রোহিঙ্গারা। তারা নিরাপদ রাখাইন চেয়েছেন। সেখানে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরত যাওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পোপের সহায়তা চেয়েছেন। রাখাইনে শান্তি ফেরাতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মোতায়নের দাবিও জানিয়েছেন তারা। কাকরাইলের গীর্জা প্রাঙ্গণে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ দাবি তুলে ধরেন রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্প থেকে আসা নারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবকসহ ৩ পরিবারের ১৬ রোহিঙ্গাকে সাক্ষাৎ দিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি এর মধ্যে থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক ১৪ জন নারী ও পুরুষ এবং ১৬ বছর বয়সী সব হারানো এক কিশোরীর বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন। শওকত আরা নামের ওই কিশোরীর বাবা মা, ভাই বোনসহ ১১ জনকে হত্যা করেছে বর্মী বাহিনী। এ সময় শওকত আরার একান্নবর্তী পরিবারের বেঁচে যাওয়া অপর ব্যক্তি তার চাচা জাফর আলম মঞ্চে ছিলেন। তিনি সৌভাগ্যবশত বেঁচে যান। তার হাতে গুলি লেগেছিলো। তিনি মারাত্মক আহত অবস্থায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসতে সক্ষম হয়েছেন। পোপের সাক্ষাৎ পেয়ে জাফর সেই গুলির ক্ষতচিহ্ন দেখিয়েছেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রায় ৩০ মিনিট সময় কাটিয়েছেন পোপ। কথা বলতে আগ্রহী প্রত্যেক রোহিঙ্গার কথা শুনেছেন তিনি। এ সময় পোপের চেহারায় ছিলো বিষাদের চিহ্ন। তিনি তাদের সবাইকে উপহারও দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের কথা বলা শেষ হওয়ার পর পোপ ফ্রান্সিস বলেন, যারা আপনাদের ওপর নির্যাতন করেছে সবার পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। মহান হৃদয়বলে আমাদের ক্ষমা করে দিন। তিনি বলেন, আপনাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা আমরা জানি। আপনাদের অধিকার ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত সহায়তা দিয়ে যাবো। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কেও আক্রান্ত মানবতার পাশে থাকার আহ্বান জানান।
বিদায়ের আগে পোপ মঞ্চে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গ্রুপ ছবি তোলেন। সেখানে পোপকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গা নেতা মাওলানা মোহাম্মদ নুরুল্লাহ তার নিজ ভাষায় মোনাজাত করেন। সেই মোনাজাতেও তিনি বর্মীদের নির্যাতনের খণ্ডচিত্র তুলে ধরেন। নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে রাখাইনে ফেরানোর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে পোপসহ বিশ্বনেতাদের জোরালো পদেক্ষপও কামনা করেন তিনি। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বর নির্যাতনের বিচারও চান এ পর্যন্ত নির্যাতিত হয়ে ৫ বার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মোহাম্মদ নুরুল্লাহ। পোপের বিদায়ের পর সাক্ষাৎ পাওয়া রোহিঙ্গারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। সাক্ষাতে আপ্লুত খায়রুল আমিন নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, রাখাইনে বিদেশি মিলিটারি মোতায়েন করতে হবে। তা নাহলে সেখানে শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ ফিরে আসবে না। আমি পোপকে তাই বলেছি। মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, আমাদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে আমরা তার বিচার চাই। নাগরিকত্ব ও মর্যাদা চাই। আমাদের যা কেড়ে নিয়েছে বর্মীরা আমরা তা ফেরত চাই। এ সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান চাই আমরা। পোপকে আমরা তাই বলেছি। এর আগে আরো ৪ বার বাংলাদেশে এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এভাবে আর কতকাল যাবে? আমার বাবা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দাদা যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। এখন আমরা করছি। আমরা স্থায়ী শান্তি চাই। পোপসহ যারা আছেন আমরা সবার সহযোগিতা চাই। বাংলাদেশ ক্যাথলিকমণ্ডলী আয়োজিত সর্বধর্মীয় সমাবেশে রোহিঙ্গারা পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। এর আগে পোপ আর্চ বিশপদের সঙ্গে বৈঠক করেন। আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃমাণ্ডলিক সমাবেশে পোপ মানবতার ঐক্য চেয়েছেন। তিনি ধর্মের নামে উগ্রপন্থার নিন্দা করেছেন। জগতে শান্তি ও সম্প্রীতি বৃদ্ধির প্রার্থনা করেছেন। ধ্বংসাত্মক ধর্মীয় মতবাদ, রাজনৈতিক মান্ধাত্ব্য এবং দুর্নীতি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান পোপ। অনুষ্ঠানে কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ, স্বামী ধ্রুবেষানন্দ, শুদ্ধানন্দ মহাথেরো এবং প্রফেসর আনিসুজ্জামান বক্তব্য রাখেন।

‘আমি রোহিঙ্গা, এটাই আমার পরিচয়। পোপের অনুষ্ঠানটি ছিলো আন্তঃধর্মীয় সমাবেশ। কিন্তু বিশ্ব মিডিয়া তথা সবার আগ্রহ ছিলো পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সাক্ষাতে। কক্সবাজারের বালুখালি ক্যাম্প থেকে ঢাকায় আগেই নিয়ে আসা হয় এক দল রোহিঙ্গাকে। কারিতাসের সহায়তায় এবং পুলিশ স্কটে কাকরাইল গীর্জা প্রাঙ্গণে সরাসরি আসেন তারা। সেখানেই আপেক্ষায় ছিলেন তারা। সেখানে কথা হয় হাজেরা খাতুন নামের এক রোহিঙ্গার সঙ্গে। তিনি বলেন, রাখাইনে তাদের ওপর এমন কোনো নির্যাতন নাই যা করা হয়নি। তারা প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে এসেছেন। এবং তারা রাখাইনে নিজ বাড়িঘরে ফিরে যেতে চান। তার স্বামী মোহাম্মদ নুরুল্লাহ্‌ নাম বলেন, আমরা এক মুহূর্ত বাংলাদেশে থাকতে চাই না। বাংলাদেশ সরকার এবং এদেশের মানুষ আমাদের প্রতি যে দয়া দেখিয়েছেন আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা ফিরতে চাই নাগরিকত্ব নিয়ে। এখন যাবো আবার নির্যাতন করবে, কেটে ফেলবে। এটা চাই না। পোপের কাছে আমাদের দাবি একটাই- আমাদের নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। সারা দুনিয়াকে আপনি বলুন- আমরা নিরাপত্তা চাই, নাগরিকত্বসহ রাখাইনে আমাদের বাপ-দাদার ভিটেই আমরা শান্তিপূর্ণ বসবাস করতে চাই। বিদেশি এক মিডিয়াকর্মী নুরুল্লাহকে প্রশ্ন করেছিলেন, তাদের রোহিঙ্গা বলাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? এর জবাবে নুরুল্লাহ বলেন, ‘আমার দাদা রোহিঙ্গা। আমার দাদি রোহিঙ্গা। আমার বাবা রোহিঙ্গা। আমিও রোহিঙ্গা- এটাই আমার পরিচয়।’