তারেক মাসুদের মৃত্যু : ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ

জেলা ট্রাইব্যুনালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবে

স্টাফ রিপোর্টার: মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ৩ মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণের এ টাকা বাস মালিক, চালক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে পরিশোধ করতে বলেছেন আদালত। তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদের মামলায় বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ বলেছেন, এতদিনের যন্ত্রণার পর আজ কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেয়েছি। তারেককে ফেরত পাব না, তবে আজকে একটা সান্ত্বনা পাচ্ছি, আমার ৭ বছরের ছেলের জন্য, যে তার বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। সান্ত্বনা পাচ্ছি তারেকের মায়ের জন্য, যিনি বড় ছেলেকে হারিয়েছেন। তিনি বলেন, রায়ে সান্ত্বনা পাচ্ছি হাজার মানুষের জন্য, যারা প্রতিদিন মর্মান্তিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় কাছের মানুষ হারাচ্ছেন। রায়ের পর ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, দীর্ঘ ৫ বছরের লড়াইয়ের সমাপ্তি হলো। মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, ছেলে নিষাদ মাসুদ এবং মা নুরুন্নাহার বেগম মামলাটি করেছিলেন। তিনি বলেন, টাকাটা চেয়েছিলাম কয়েকটা খাতে। সেগুলো হলো তারেক মাসুদ মূল উপার্জনকারী ছিলেন, মৃত্যুর কারণে উপার্জন কমে গেছে। তার স্নেহ এবং ভালোবাসা হারিয়েছে। ক্যাথরিন নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তার চোখের ক্ষতি হয়েছে। মাইক্রোবাসটি ড্যামেজ হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ক্ষতি পূরণের দাবি অবশ্যই সবার জন্য থাকা উচিত। প্রত্যেক জেলা জজ আদালতের ট্রাইব্যুনালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন। আদালত সব গাড়ি চালকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদেরও ব্যক্তিগতভাবে দায় নিতে হবে। না হলে তারা সতর্ক হবেন না।
আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী বলেছেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পেলে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মামলার রায় ঘোষণা শুরু হয় বুধবার সকালে। বৃহস্পতিবার ও রোববার দুপুর পর্যন্ত রায় পড়া চলে এবং এরপর আদালত ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, যারা দুর্ঘটনা এবং মর্মান্তিক এ মৃত্যুর জন্য দায়ী তাদের ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা দিতে হবে। এর মধ্যে বাসচালক দেবেন ৩০ লাখ টাকা, বীমা কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি দেবে ৮০ হাজার টাকা, বাকি ৪ কোটি ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫২ টাকা দেবে তিন বাস মালিক। অর্থাৎ প্রত্যেক মালিককে দিতে হবে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৬৫ হাজার ১৫১ টাকা। ক্ষতিপূরণের এ অর্থ পাবেন তারেক মাসুদের স্ত্রী, তাদের ছেলে এবং তারেকের মা।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, প্রত্যেক জেলা জজ আদালতে একটি ট্রাইব্যুনাল থাকার কথা, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, প্রতিনিয়ত যারা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন তারা কিন্তু সেখানে গিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারছেন না। আদালত আশা করছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীর। তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটির সঙ্গে চুয়াডাঙ্গাগামী একটি বাসের সংঘর্ষ হয়। এতে তারেক ও মুনীরসহ মাইক্রোবাসের পাঁচ আরোহী নিহত হন। পরে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে।
সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ব্যক্তিসহ পাঁচজনের মৃত্যুর ওই ঘটনা পুরো দেশকে নাড়া দেয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মানিকগঞ্জের আদালত চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের ওই বাসের চালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও সেখানে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আসেনি। দুর্ঘটনার দেড় বছর পর ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তারেক ও মিশুকের পরিবারের পক্ষ থেকে মোটরযান অর্ডিন্যান্সে ১২৮ ধারায় বাস মালিক, চালক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের দুটি মামলা করা হয় মানিকগঞ্জে। পরে বাদীপক্ষের আবেদনে জনস্বার্থে মামলা দুটি হাইকোর্টে স্থানান্তর করা হয়। ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ হাইকোর্টে তারেক মাসুদের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হলে প্রথম দিন সাক্ষ্য দেন তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। বাদীপক্ষে এ মামলায় মোট ৯ কোটি ৯৪ লাখ ৩০ হাজার ৯৮ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, অবশ্যই একেকজনের আয় ভিন্ন হতে পারে। এটা রোজগারের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু কারও স্নেহ ও স্বজনের ভালোবাসা থেকে কেউ যদি বঞ্চিত হয় তাহলে সবার জন্য একই মাপকাঠিতে ক্ষতিপূরণ দাবি করার অধিকার থাকবে।
রায়ের পর ক্যাথরিন মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের মধ্যে দিয়ে আইনগতভাবে স্বীকৃত হচ্ছে যে, এ তথাকথিত দুর্ঘটনা আসলেই দুর্ঘটনা নয়, এ সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে ড্রাইভার, কোম্পানি ও এমনকি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দায় আছে।
তারেক মাসুদের পরিবারের পক্ষে শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইসরাত জাহান। হাইকোর্টে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুস সুবহান তরফদার। বীমা কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী, শিশির মনির ও সৈয়দ মুহাম্মদ বুরহান উদ্দিন।
মুক্তির গান ও মাটির ময়না চলচ্চিত্রের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তখন তার নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’-এর শুটিং শুরুর কাজ করছিলেন। সাংবাদিকতার সাবেক শিক্ষক মিশুক মুনীর তখন টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। কাগজের ফুল’র লোকেশন দেখতেই তারা মানিকগঞ্জে গিয়েছিলেন। এদিকে এ দুর্ঘটনায় নিহত মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলি কাজী এবং ছেলে সুহৃদ মুনীরের করা মামলাটি ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে শুনানির জন্য রাখা হয়েছে।
রায়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির অভিনন্দন : তারেক মাসুদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার রায়কে ঐতিহাসিক বলে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
গতকাল রোববার বিকেলে এক বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দীর্ঘ ৬ বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরে তারেক মাসুদের পরিবার হতাশ হননি। পরিশেষে হাইকোর্ট মামলায় যে রায় দিয়েছেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।