নিম্ন আদালতের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতি ও আইন মন্ত্রণালয়

স্টাফ রিপোর্টার: অবশেষে নিম্নআদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা গতকাল সোমবার গেজেট আকারে জারি হয়েছে। বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ১৮ বছর এবং বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে গত তিন বছর ধরে টানাপোড়নের পর এই বিধিমালা জারি করল সরকার। তবে পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ যে বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছিলো জারিকৃত বিধিমালায় তার কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। যদিও এই বিধিমালা জারির পূর্বে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আপিল বিভাগের সঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বৈঠকে মতপার্থক্য দূর হয়েছে বলে জানানো হয়েছিলো। জারিকৃত বিধিমালায় নিম্নআদালতের বিচারকদের ‘নিয়োগকারী’ কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতিকে করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এবং আইন মন্ত্রণালয়কে নিম্নআদালতের বিচারকদের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হিসাবেও নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে পরোক্ষাভাবে নিম্নআদালত বা এই আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে থেকে যাবে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া রাষ্ট্রপতি না চাইলে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত কোন বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারবে না সুপ্রিম কোর্ট।

২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়। সে সময় দুটি বিধিমালা জারি হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বিধিমালা জারি হলেও নিম্নআদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা বিধিমালা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। সুপ্রিম কোর্ট বারবার বিধিমালা জারির জন্য তাগাদা দিলেও সরকার ২৫ বারেরও বেশি সময় নেয়। এক পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের দাখিলকৃত খসড়া কিছুটা সংশোধন ও পরিমার্জন করে তা বিধিমালা আকারে জারির জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়। কিন্তু কয়েকটি ইস্যুতে দুই বিভাগের মতপার্থক্যের কারণে সরকার বিধিমালা জারি থেকে বিরত থাকে। পদত্যাগকারী প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ বিষয়টি সুরাহা করতে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হককে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আইনমন্ত্রীর নানা ব্যস্ততার কারণে সেই বৈঠক হতে পারেনি।  বিচারপতি এসকে সিনহার পদত্যাগের পর আইনমন্ত্রীর সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

জানা গেছে, এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ যে বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত করে দিয়েছিলেন গতকাল জারিকৃত বিধিমালায় তার কিছু অংশ ফেলে দেয়া হয়েছে। সে সময় সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্তকৃত খসড়ায় বলা হয়েছিল, জুডিশিয়াল সার্ভিসের কোনো সদস্য প্রেষণে কর্মরত থাকলে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের অনুসন্ধানের প্রয়োজন দেখা দিলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (রাষ্ট্রপতি) সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ প্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে ওই কর্মকর্তা যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত ওই মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে অনুসন্ধান কমিটি করবে। তবে একজন জেলা জজ হবেন ওই কমিটির সভাপতি। গতকাল জারিকৃত বিধিমালায় এই অংশটি নেই। জারিকৃত বিধিমালায় অতিরিক্ত সচিব বা তার তদুর্ধ্ব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে সভাপতি করার কথা বলা হয়েছে।

জারিকৃত বিধিমালার ৪(১) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে যদি তদন্ত করে এবং ওই তদন্তে যদি প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায় তথাপি রাষ্ট্রপতি না চাইলে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু করা যাবে না। এ সংক্রান্ত ৪(ক) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি বা আইন মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিবে। ৪(খ) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্রপতি বা আইন মন্ত্রণালয় ১৫ দিনের মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে লিখিত বক্তব্য প্রদানের নির্দেশ দিবেন। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন বিষয়টি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধানের প্রয়োজন তাহলে অভিযুক্ত কর্মকর্তার লিখিত বক্তব্যসহ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণের জন্য প্রেরণ করবেন।

ফলে দেখা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট নিজে উদ্যোগী হয়ে নিম্নআদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বা হাইকোর্টের বিচারকদের নিম্নআদালতের পরিদর্শন সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোন তদন্ত করতে পারবে না। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাষ্ট্রপতি বা আইন মন্ত্রণালয় না চাইলে তো সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে উত্থাপিত কোন অভিযোগের তদন্ত সম্ভব না। এর ফলে প্রচ্ছন্নভাবে নিম্নআদালতের বিচারকদের ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাব থেকেই যাবে।

বিধিমালায় কোন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিরস্কার বা ভর্ত্সনা; নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পদোন্নতি স্থগিত রাখা (এক বছরের বেশি নয়); বাত্সরিক বেতন বৃদ্ধি তিন বছর স্থগিত; বেতন স্কেলের নিম্নধাপে তিন বছর পর্যন্ত বর্ধিত যোগ্য সময়ের জন্য অবনমিত করে দেয়া ইত্যাদি শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এছাড়া অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপে লিপ্ত থাকলে বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি হতে অপসারণ এবং বরখাস্তেরও নির্দেশনা রয়েছে। তবে চাকরি হতে বরখাস্ত, অপসারণ এবং অব্যাহতি দেয়া হলেও কোনো সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ থাকবে।