সমঝোতা ছাড়াই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো

স্টাফ রিপোর্টার: সমঝোতা ছাড়াই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। ইতোমধ্যে নির্বাচনী আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে তৃণমূলে। নির্বাচন কমিশনও রোডম্যাপ প্রস্তুত করে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিভিন্ন মহল ২০১৮ সালকে ‘নির্বাচনী বছর’ আখ্যাও দিয়েছে। অথচ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি থেকে এখন পর্যন্ত একটুও সরেনি সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপি। অন্যদিকে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট-মহাজোট।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে নির্বাচনের আমেজ থাকলেও অমীমাংসিত ইস্যু বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। বরং চরম রাজনৈতিক সংকটের দিকে এগুচ্ছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এতে করে নির্বাচন নিয়ে দেখা দিতে পারে সংশয়।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে বলছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া জোর দিয়ে বলছেন, তিনি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। আবার প্রধানমন্ত্রী বলছেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। উনারা যদি নির্বাচন নিয়ে এমন কথা বলেন, তাহলে আগামীতে নির্বাচন হবে বলে মনে হয় না।

সাবেক এই উপদেষ্টা আরও বলেন, বড় দুই দলের সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধ কমিয়ে আনতে না পারলে একটা সংঘাতপূর্ণ অবস্থা তৈরি হবে। এটা কারো জন্য ভালো হবে না। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতোটুকু সম্ভব অংশগ্রহণমূলক করার কথা ভাবছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে এ ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকার বা সমঝোতা ইস্যুতে কিংবা নির্বাচনের সময় বিএনপিকে কোনো ছাড় দিতে চায় না তারা। তাদের (আ’লীগ) সব আলোচনা এখন জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক। নির্বাচনী ইশতেহার লেখার কাজও শুরু হয়েছে তাদের। সরকার গঠনে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড করতে নির্বাচনকে ঘিরে প্রস্তুতি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দলটিতে।

ক্ষমতাসীন দলটি আগামী নির্বাচন মাথায় রেখে সরকারের গৃহীত উন্নয়নমূলক কাজগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শেষ করার ওপর গুরুত্বারোপ করছে। চলছে প্রার্থী যাচাই-বাছায়ের কাজ। নির্দিষ্ট সময়ের বিরতিতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ওপর জরিপ কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান এমপি ও মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা নির্বাচনী এলাকায় বেশি বেশি সময় দিচ্ছেন। দলের শীর্ষপর্যায় থেকে বাড়ি-গ্রাম-গঞ্জ, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলায় উঠান বৈঠকের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমান এমপিসহ মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এতে নির্বাচনী প্রচারণা উৎসবে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, শেখ হাসিনা বা দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। এমনকি সরকারকে ছাড়ও দেবে না। এক্ষেত্রে বিএনপি আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা আলোচনা, পর্যালোচনা শুরু করেছে। মূলত আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে চায় তারা। এজন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে তারা বিদেশি সংস্থা বা বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে মনে করিয়ে দিতে চায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য হবে না। এক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে। এসবে কাজ না হলে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যেমে এর সমাধান চায় বিএনপি।

জানা গেছে, দলীয় জোটের বাইরের সরকারবিরোধী ডান, বাম, মধ্যপন্থী দলগুলোকে নিয়ে দু-এক মাসের মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের কথা ভাবছে বিএনপি। এ আন্দোলন হবে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে। পাশাপাশি নির্বাচনী জোট গঠনেও কাজ চলছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ছোট ছোট রাজনৈতক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। তবে দেশের চলমান বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে এ বিষয়ে কৌশলী অবস্থানে বিএনপি।

পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউ ছাড় দেবে না। এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দুই দল। এতে ঘণীভূত হচ্ছে সংকট, যেটা দু’দলের জন্যই ক্ষতি ডেকে আনবে। আর সেখান থেকে উত্তরণও কঠিন হবে।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুই দলে মুখোমুখি অবস্থান যেন এদেশের রাজনীতির একটা চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে এভাবেই চলবে। তবে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে- এমন প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, উভয় দল এখন যার যার অবস্থানে অনড় আছে। তবে শেষ পর্যন্ত দুই দল কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে।

উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ নিবন্ধিত প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দল। কার্যত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট এবং সমমনা কয়েকটি দল ছাড়া কেউ ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বিনা ভোটে নির্বাচিত হন সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৩ জন সংসদ সদস্য। ওই নির্বাচন ঘিরে টানা অবরোধ, হরতালসহ আন্দোলনের নানা কর্মসূচি দিয়ে ২০১৩ ও ২০১৪ সাল জুড়ে রাজপথে ছিল বিএনপি। তবে সরকার দাবি মেনে নেয়ার পরিবর্তে বিরোধী জোটের ওপর কঠোর হয়। দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে সরে এসে গত দুই বছর (২০১৬ ও ২০১৭) ধরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। তবে গত কয়েক মাস যাবৎ বিএনপির নেতাদের কেউ বলছেন, সরকারকে আর খালি মাঠে গোল দিতে দেয়া হবে না। আবার এও বলছেন শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে বিএনপি যাবে না।

সংলাপ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি গণভবনে বলেছেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের (বিএনপি) সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেয়া সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। তাতে কেউ অংশ নিলে নেবে, না নিলে না নেবে- সেটা তাদের দলের সিদ্ধান্ত্ম। তাদের কিছু বলার দরকার নেই। তবে বিএনপি মনে হয়- আর আগের মতো ভুল করবে না, নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসবে।

আওয়ামী লীগ নেতারাও মনে করেন, কোনো শর্ত মানা বা সংলাপের প্রয়োজন হবে না। বিএনপি তার প্রয়োজনে নির্বাচনে আসবে। টানা দুই জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিলের ভয় ও রাজনীতির মাঠে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এমনিতেই নির্বাচনে আসবে তারা। যদি নাও আসে, তাতেও বিএনপিকে ছাড় দেয়া ঠিক হবে না।

অন্যদিকে বিএনপির হাইকমান্ড মনে করে, এবারের নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলেই বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করবে। সে ক্ষেত্রে সবার আগে দলটি সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা চায়। এজন্য ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের যে কোনো সময় নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার আদায়ে আন্দোলন শুরু করা হবে। বিএনপির এক নেতা জানান, দৃশ্যমান ঐক্য না হলেও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের পথে থাকাই এখন বিএনপির লক্ষ্য।

তবে বিএনপির কোনো দাবি মানা হবে না বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সংবিধানের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই নির্বাচন হবে। বিএনপি যদি নির্বাচনে আসতে চায় তাহলে বাংলাদেশের আইন মেনে নির্বাচনে আসতে হবে। তাদের জন্য কোনো নতুন আইন করে নির্বাচনে আনার প্রশ্নই ওঠে না।

এদিকে আগামী একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রস্তুত করে সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে সংস্থাটি। সংবিধান অনুযায়ী দশম সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিন আগে নির্বাচন করতে হবে। সেই হিসাবে আগামী বছরের ডিসেম্বর মাসকে টার্গেট ধরে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে তারা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, ২০১৪’র ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচনকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ইসি নতুন নির্বাচনের দিকে হাঁটছে। তাই ইসির সবার আগে রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

আওয়ামী লীগের ধারণা, মুখে এখন যাই বলুক না কেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো বিএনপি আগামী নির্বাচন বর্জন করবে না। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের বেশির ভাগেরও অভিন্ন বিশ্বাস। কারণ নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী বিএনপি এবার নির্বাচনে আসতে বাধ্য। ওই ধারা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করবে। কেননা এতে বলা হয়েছে, কোনো দল যদি পরপর দুইবার নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে ওই দলটিকে শুনানিতে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। কমিশনের কাছে দলটির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলেই কেবল তারা নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত্ম নিতে পারবে। এ অবস্থায় দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি নিবন্ধন বাঁচাতে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হবে কি হবে না, এটা আওয়ামী লীগ বলার কে? বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল, গণমানুষের দল, মুক্তিযুদ্ধের দল। গণতন্ত্রের প্রয়োজনেই বিএনপির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফলে নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে, নিঃশেষ হবে- এমন বক্তব্যের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।

এসব বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দু’পক্ষই তাদের নিজেদের অবস্থানে অনড়। দুই দলই তাদের সুবিধাজনকভাবে নির্বাচন করতে চায় এটাই স্বাভাবিক। এখন সময়ই বলে দেবে কি ঘটবে।

তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দল তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে চাইবে না। বেগম জিয়াও দেখাতে চাইবে তার শক্তিমত্তা কতোটুকু আছে…। তার ওপর নির্ভর করবে আগামীদিনে কি হতে যাচ্ছে।’ সুজন সম্পাদক বলেন, ‘আমরা নাগরিক হিসেবে চাই- একটা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন, যার মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন হবে। জনগণ ভোট দিতে চায়, তারা যেন ভোট দিতে পারে। সমঝোতার আহ্বান জানাতেই পারেন।’