কনডেম সেলে দিনে হারিকেন জ্বালিয়ে ভাত খেয়েছি

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি

সাইফুল ইসলাম রাজ: মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, আমাকে যখন রাজশাহীর কনডেম সেলে রাখা হয়েছিলো তখন দিনে হারিকেন জ্বালিয়ে ভাত খেতে হতো। কনডেম সেলের পাশেই ছিলো ফাঁসির মঞ্চ। এটা দেখা যেতো। রাষ্ট্রপতি কিছুটা কৌতুক করে বলেন, কনডেম সেলের পাশে ফাঁসির মঞ্চ থাকায় ভাবতাম এর পরেই আমাকে ফাঁসির সেলে নিয়ে যাওয়া হবে কি-না। পরে অনেক তদবির করে আমাকে ঢাকা জেলে ট্রান্সফার করে নিয়ে আসে। এখানে আমার স্ত্রীর অবদানই বেশি। গতকাল রোববার কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
জেল জীবনের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ১৯৭৬ সালে আমি ময়মনসিংহে ৭ মাস জেল খেটেছি। পরে আমাকে কুষ্টিয়ায় ট্রান্সফার করা হয়। কুষ্টিয়ায় চার মাস কারগারে থাকার পর আবার আমাকে রাজশাহীতে ট্রান্সফার করা হয়। রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সারাজীবনে কোনো ধরনের কনভিশন (দ-াজ্ঞা) কাটিনাই, কিন্তু জেলখানার ভেতরে গিয়ে আমি ঠিকই কনভিশন কাটছি। তবে একটি কাজ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছি। তিনি বলেন, কুষ্টিয়াতে যাওয়ার সময় ডানো দুধের পাউডার কোটায় এক হাজার টাকা গোপনে রেখে দিয়েছিলাম যাতে ধরা না পড়ে। এটা রাজশাহীতে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে যায়। অবৈধভাবে টাকা রাখার সাজা হিসেবে জেলার এক হাজার টাকা কনফিসকেট (জব্দ করে) কাটে। এ সময় তিনি কৌতুক করে বলেন, মনে মনে ভাবলাম যাক টাকার ওপর দিয়ে গেছে। পরে জেলার আমাকে রেফার করলো ডিআইজি প্রিজনে। ডিআইজি প্রিজন আমাকে তো এক হাজার টাকা কসফিসকেট করলোই পাশাপাশি আমাকে দিলো কনডেম সেলে। কুষ্টিয়ার জেল জীবনের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন, কুষ্টিয়ার কারাগারে থাকার সময় ১৯৭৬ সালের ১৩ জানুয়ারি আমার কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। এ সময় স্ত্রীর কাছ থেকে চিঠি আসে মেয়ের নাম রাখার বিষয়ে। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না মেয়ের নাম কি রাখা যায়। এ ব্যাপারে কারও সাথে পরামর্শ করারও উপায় ছিলো না। অবশ্য আমার ওয়ার্ডে এ সময় আমার সাথে আরও তিন জন ছিলেন। তিনি বলেন, যেহেতু ব্রিটিশ পিরিয়ডে কুষ্টিয়া ছিলো নদীয়া জেলা, তাই অবশেষে জেলার নামে মেয়ের নাম রেখে দিলাম নদীয়া। কারাগার থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সহধর্মিনী রাশেদা খানম বিশেষ ভূমিকা রাখেন বলে তিনি এ সময় জানান। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির স্ত্রী রাশেদা খানম ও মেয়ে স্বর্ণা হামিদ উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতির স্মৃতিচারণের সময় সহধর্মিনী রাশেদা খানমকে অশ্রুস্কিত দেখা যায়।
এর আগে অনুষ্ঠান শুরুর আগে রাষ্ট্রপতি বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’ ম্যুরাল উদ্বোধন করেন। বেলা সোয়া ১২টায় সমাবর্তনের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন উর রশিদ আসকারী। গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, আমার খুব ইচ্ছে হয় আপনাদের কাছে যেতে, আপনাদের সাথে মিশতে। কিন্তু এসএসএফ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) আমাকে এলাও করে না। তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম রাষ্ট্রপতি হলাম তখন ভেবেছিলাম সমাবর্তনে যাওয়া মানে শিক্ষার্থীদের সাথে হৈ হুল্লোড় করা। আনন্দ করা। মিশে যাওয়া। কিন্তু এটা হয়ে ওঠে না। তিনি খানিকটা কৌতুক করে বলেন, সমাবর্তনের প্যান্ডেলের বেড়ার কারণে আমি শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে দেখতে পায় না। ভেতরটা অন্ধকার থাকে। আপনাদের কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে প্রবল কিন্তু পারিনি।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে শীত প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ঠা-া একটু বেশি। গলা বসে গেছে। এছাড়া আজকে জাতীয় সংসদের অধিবেশন আছে। সংবিধানের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী আমাকে বছরের শুরুর সংসদের অধিবেশনে থাকতে হবে। সবমিলিয়ে দোটানায় ছিলাম সমাবর্তনে আসতে পারবো কি-না। তবে কুষ্টিয়ার প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকার কারণে এসেছি। সাথে আমার স্ত্রী এসেছে। গ্র্যাজুয়েটেদের উদ্দেশে তিনি বলেন, দেশ ও জাতির প্রতি তোমাদের রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও অঙ্গীকার। তোমরা নিষ্ঠা ও বিশ^স্ততার সাথে এই দায়িত্ব পালনে উন্মুখ বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের অর্জিত জ্ঞানের সফল প্রয়োগ ঘটাতে পারলে দেশ অনেক সমস্যা থেকে মুক্ত হবে এবং দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তার বক্তব্যে বলেন, বর্তমান সময়ে মাদকাসক্তের মতো সোস্যাল মিডিয়া একটি নেশা। এই নেশার কারণে আমরা কোনো কিছু মন দিয়ে করি না। গবেষণা করি না। তরুণেরা শুধুমাত্র সময় অপচয়ের কাজে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে। তিনি গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে বলেন, তোমাদের একটি লাইন মনে রাখতে হবে। লাইনটি হলো-তোমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করো, কিন্তু প্রযুক্তি যেন তোমাদের ব্যবহার করতে না পারে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, উপ-উপাচার্য অধ্যাক ড. মো. শাহিনুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সেলিম তোহা প্রমূখ।
প্রসঙ্গত, গতকাল রোববার বিশ^বিদ্যালয়ের চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি বিষয়ে মোট ৯ হাজার ৩৭২ জনকে সনদ প্রদান করা হয়।