তীব্র শীতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

স্টাফ রিপোর্টার: তীব্র শীতে যবুথবু সারাদেশের মানুষ। আজ দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের অনেক স্থানে সূর্যের দেখা মেলেনি। এতো কম তাপমাত্রার সাথে মানুষ অভ্যস্ত নয় বলে মুখ থুবড়ে পড়েছে জীবনধারা; জীবন হয়ে উঠছে নাভিশ্বাস। এ সময় মানুষের সর্দি-কাশি, আর্থ্রাইটিস বা বাত ব্যথা, টনসিলাইটিস, অ্যাজমা বা শ্বাস-কষ্ট, হার্টের সমস্যা হচ্ছে প্রচুর। সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে ভিড় লেগেই আছে রোগীদের। বিশেষ করে শিশুরা অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, কোল্ড ডায়রিয়া, ব্রংকিওলাইটিস ও স্ক্যাবিসসহ নানা রোগে বেশি ভুগছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীদের। এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে বরং বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, এতো বেশি শীতে একটু বাড়তিই সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে। এ সময় সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সাইনাস, কান ও টনসিলের প্রদাহ বাড়ে। এজন্য পরিবারের সবার উচিত কুসুম কুসুম গরম পানি খাওয়া। এছাড়া গোসল ও অন্যান্য কাজে গরম পানির ব্যবহার তেমন সমস্যা তৈরি করে না। তিনি বলেন, পরিবারের কেউ ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হলে অন্যদেরও সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে কাঁশি-হাঁচির সময় মুখে রুমাল ব্যবহার করতে হবে। বাসায় সচরাচর হয় এমন কিছু রোগের ওষুধ রাখতেও তিনি পরামর্শ দেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, তীব্র শীতে বিশেষ করে ভোরের দিকে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। এ সময় স্কেমিয়ায় আক্রান্তদের অ্যানজাইনা বা বুকে ব্যথা বেড়ে যায়। যাদের উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ঝুঁকি বেশি। রক্তনালী সঙ্কুচিত হয়ে বা ব্লক হয়ে হার্ট অ্যাটাকের হারও বেড়ে যায়। তবে কেউ যদি বুঝতে পারেন, কারো হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে, জিহ্বার নিচে নাইট্রেড গ্লিসারিন দ্রুত স্প্রে করা উচিত। অথবা অ্যাসপিরিন ৩০০ গ্রাম (ইকোস্প্রিন ৪টা ট্যাবলেট) চিবিয়ে খেয়ে দ্রুত হৃদরোগ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যাওয়া উচিত।

তিনি বলেন, এ শীতে কুয়াশার মধ্যে নয় বরং একটু রোদ উঠলেই বাইরে বের হয়ে হাটাহাটি বা ব্যায়াম করা উচিত। পাশাপাশি সালাদ জাতীয় খাবার, সিজনাল ফলমূল বেশি খাওয়া উচিত।

তীব্র এ শীতে শিশুরা নিউমোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিসহ নানা রোগে ভুগছে। এখনও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাসকারী, ইমিউন সিস্টেম দুর্বল শিশু, স্বল্প ওজনি-অকালজাত (প্রি-ম্যাচিওর) নবজাতকরা এতে বেশি ভোগে। বারডেম জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, এ সময় শিশুদের শীত উপযোগী হালকা ও নরম কাপড় পরিধান করাতে হবে। সম্ভব হলে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঘর থেকে বাইরে বের না করাই উত্তম। শরীরের তাপমাত্রা যেন খুব বেশি কমে না যায়-এ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, অন্তত গরম কাপড় দিয়ে শিশুদের মাথার অংশটা ঢেকে রাখলে শরীরের সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকবে। তিনি বলেন, লম্বা সময় ধরে রুম হিটার ব্যবহারের কারণে চামড়া শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। এজন্য ঘরের কোথাও আলাদা বালতি বা গামলায় কিছুটা পানি রেখে দিয়ে রুম হিটার ব্যবহার করলে এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা আরও বলেন, শিশুদের অ্যাজমা প্রতিরোধে অবশ্যই বাইরের ধুলোবালি বা ফুলের রেণুর প্রভাবমুক্ত থাকাসহ মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি হেলথ হাইজিনের বিষয়টি বেশ জরুরি। অনেক শিশু বিশেষ করে মাদরাসা পড়ুয়া শিশুরা অনেকে একত্রে ঘুমায়; একে অন্যের কাপড়-চোপড় শেয়ার করে। এ থেকে স্ক্যাবিস বা খোশপঁচড়া জাতীয় চর্মরোগ হতে পারে। এ কারণে পরবর্তীতে প্রচুর শিশু কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়। তাই প্রত্যেকের উচিত আলাদা আলাদা জামা-কাপড় ব্যবহার করা।

আর্থাইটিস বা বাতের সমস্যা শীতে বেশি বাড়ে। মূলত বয়স্কদেরই এ সমস্যা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউম্যাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মিনহাজ রহিম চৌধুরী বলেন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা এনকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াসিটিস, অস্টিও-আর্থ্রাইটিস রোগীদের শীতের চলাফেরা বা মুভমেন্ট কম হয় বলে ব্যাথার প্রকোপ বেড়ে যায়। চলাফেরায় বরং ব্যাথা কম হয়। তাছাড়া তীব্র ঠাণ্ডায় বাতের কিছু রোগীর (রেনোড ফেনোমেনা) হাত-পা নীল হয়ে যেতে পারে। অনেকের গ্যাংগ্রিনও হয়। এজন্য যথাসম্ভব গরম উত্তাপে থাকা, হালকা গরম সেক দেয়া, মোজা পরিধান করা, যতটুকু সম্ভব ঘরেই হালকা মুভমেন্ট করা ও চিকিৎসকদের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। তিনি বলেন, এসব রোগীদের আমরা বারবার পানি ব্যবহার না করে প্রয়োজনে গরম পানি ব্যবহার বা তায়াম্মুম করে নামাজ পড়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি।

অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের খুব ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপাইরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, দিনের মধ্যভাগে ধুলোবালু, কলকারখানা বা যানবাহনের কালো ধোয়া থেকে বাতাসে ঝুলন্ত কণায় সাধারণত পরিবেশ দূষণ হয় বেশি। অ্যাজমার রোগীদের প্রচুর হালকা গরম পানি পান করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এতে শ্বাসনালিতে মিউকাস তৈরি হয়ে রোগজীবাণু বের হয়ে যায়। আর ওষুধগুলো ইনহেলারের সাহায্যে ব্যবহার করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়। কোনো কারণে অ্যাজমা পরিস্থিতির হঠাৎ অবনতি হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে অক্সিজেন, নেবুলাইজার প্রয়োগসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা দিতে হবে।

অধ্যাপক একেএম মোশাররফ হোসেন বলেন, তীব্র শীতের একটি মারাত্মক সমস্যা হলো হাইপোথার্মিয়া, অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া, এতে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে। এজন্য যেকোনোভাবেই হোক সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে। এ পরিস্থিতিতে কেউ পড়লে রোগীকে দ্রুত গরম আবহাওয়ায় এনে গরম কাপড় পড়িয়ে গরম পানি পান করাতে হবে। তিনি বলেন, ৪০ ঊর্ধ্ব ব্যক্তির কোনো রোগ হোক বা না হোক তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন বা টিকা নেয়া উচিত।

শীত সহায়ক কিছু খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ডায়েট প্লানেট অ্যান্ড নিউট্রিশন কনসালটেন্সির পুষ্টিবিদ মাহবুবা চৌধুরী বলেন, শীতের উপযোগী কিছু মরসুমি ফলমূল রয়েছে, যা বেশ পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। তাই এ শীতে কমলা, স্ট্রবেরি, বেদানা, মধু, তুলসীপাতা, পালং ও সরিষার শাক, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, রসুন, পিয়াজ, আদা, সবুজ শাকসবজি ও গ্রিন টি বেশি করে খাওয়া উচিত।