প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পেছনে জঙ্গি আস্তানা : র‌্যবের অভিযানে নিহত তিন জঙ্গি

ভবন উড়িয়ে দেয়ার চেষ্ঠা : গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীতে ‘জঙ্গি আস্তানায়’ র‌্যাবের অভিযানে তিন জঙ্গি নিহত হয়েছে। ১৩/১ পশ্চিম নাখালপাড়ার ‘রুবি ভিলা’ নামের ছয়তলা ভবনে এ অভিযান চালানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পেছনের সীমানা পাঁচিলের থেকে দুইশ’ গজ দূরে এবং পার্শ্ববর্তী পুরাতন এমপি হোস্টেলের সীমানা পাঁচিলের ঠিক পেছনে ভবনটির অবস্থান। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাত দুইটায় র‌্যাব সদস্যরা ভবনটি ঘিরে ফেলে। ভোরে এলাকাবাসীর ঘুম ভাঙে তুমুল গোলাগুলির শব্দে। এ সময় গোটা এলাকায় আতঙ্ক দেখা দেয়। অভিযান চলাকালে ভবনের পঞ্চমতলা থেকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। নিরাপত্তার স্বার্থে এলাকার বিভিন্ন সড়কে তখন যানচলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। গতকাল শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ঘটনাস্থলে কাজ শুরু করে।

র‌্যাব জানিয়েছে, গত ২৯ ডিসেম্বর জাহিদ নামে এক যুবক পঞ্চমতলার একটি রুম সাড়ে ৫ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। গত ৪ জানুয়ারি জাহিদ ওই কক্ষে ওঠেন। ৮ জানুয়ারি আরো দুইজন ওই কক্ষে ওঠেন। তবে তারা ভুয়া আইডি ব্যবহার করেছিলেন বলে সন্দেহ করছে র‌্যাব। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানিয়েছেন, এ ঘটনায় ওই ভবনের ম্যানেজার রুবেল, মেসের বাসিন্দা তৌহিদ ও শীতলকে র‌্যাবের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাড়ির মালিক বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট পার্সার শাহ মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন বিমানের একটি ফ্লাইটে আবুধাবি থেকে গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে এসে পৌঁছুলে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব হেফাজতে নেয়া হয়।  অভিযান চলাকালে জঙ্গিরা গ্যাসের চুলায় গ্রেনেড রেখে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা করেছিলো। জঙ্গিরা একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরেছিলো র‌্যাব সদস্যদের দিকে। গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় র‌্যাব সদস্যরা প্রাণে বেঁচে যান। এ সময় র‌্যাব সদস্যরা ওই কক্ষে গুলি ছোঁড়ে। এতে জাহিদ ওরফে সজীবসহ ৩ জন নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে র‌্যাব দুটি পিস্তল, তিনটি সুইসাইডাল ভেস্ট, তিনটি ইলেকট্রনিক্স আইডি, ১৪টি ডেটোনেটর, চারটি পাওয়ার জেল, ৪৪ টি গুলির খোসা, সাদাকালো রঙের তিনটি স্কার্ফ ও একটি বটি উদ্ধার করেছে। অভিযানের পর সিআইডির ক্রাইমসিন প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করেন। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩ টার দিকে ৩ জনের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। অভিযান শেষ হয় গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টায়।

উল্লেখ্য, গত চার বছরে এই ভবন থেকে বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি সন্দেহে ১২ জনকে গ্রেফতার করেছিলো।

অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, নিহত তিনজনই পুরুষ। তাদের বয়স ২৫ থেকে ২৭ এর মধ্যে। তাদের নাম-পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। একজনের নাম জাহিদ অথবা সজীব হতে পারে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পেরেছি তারা জেএমবি সদস্য। গত ৪ জানুয়ারি আইডি কার্ড ব্যবহার করে তারা ওই বাড়ির মেসের একটি কক্ষ ভাড়া নেয়। আমরা জাহিদ নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ভেতরে পেয়েছি। তবে এটা আসল কিনা নিশ্চিত না। একই জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিতে অন্য নাম। ফটোকপিতে লেখা সজীব। তাই আমরা ধারণা করছি জাতীয় পরিচয়পত্রটি ভুয়া।

র‌্যাবের অভিযান: র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার চারটি ফ্ল্যাটের মধ্যে তিনটিই মেস হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছিলো। মেসে জঙ্গিরা অবস্থান করে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করিছিলো। এর ভিত্তিতে ওই ভবনের পঞ্চম তলায় অভিযান চালানো হয়। পুরো ভবনে দশটি ফ্ল্যাটে ৬০ জনের বেশি মানুষের বসবাস। অভিযানের সময় র‌্যাব ওই ভবনের প্রধান ফটক ভেঙ্গে তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়।

এলাকাবাসী জানান, বাড়ির মালিক সাব্বির হোসেনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। তার বাড়ির পাঁচ ও ছয়তলায় মেস হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়। একবার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিলো, পরে আবার ছেড়ে দেয়। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে তিনি বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় থাকেন।

ভবন উড়িয়ে দেয়ার চেষ্ঠা করেছিলো জঙ্গিরাঃ র‌্যাব জানায়, রুবি ভিলাতে অভিযান শুরু হলে জঙ্গিরা প্রথমে র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। জবাবে র‌্যাব গুলি চালালে জঙ্গিরাও গুলি চালায়। অভিযান শুরুর আগেই জঙ্গিরা রুমের সাথে থাকা রান্না ঘরের গ্যাসের চুলায় আগুন ধরায়। এরপর সেই চুলায় গ্রেনেড বসিয়ে রাখে। জঙ্গিদের চেষ্টা ছিলো গ্রেনেডটির বিস্ফোরণ ঘটানো। কিন্তু র‌্যাবের বোম ডিস্পোজাল ইউনিট বিষয়টি বুঝতে পেরে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে। এরপরই তারা অভিযান শুরু করে।

অভিযান সম্পর্কে পশ্চিম নাখালপাড়ার ষাটোর্ধ্ব এক নারী জানান, তার জন্ম এখানেই। এক বছর আগেও এই ভবন থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায় তেজগাঁও থানার পুলিশ। পরে তারা জেনেছিলেন, তাদের জঙ্গি সন্দেহেই গ্রেফতার করা হয়েছিলো।

পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রথমে একটা শব্দ পাই। এর কিছুক্ষণ পর আবার শব্দ। আমরা প্রথমে ভেবেছি আতশবাজি হচ্ছে। ওই বাড়ির (রুবি ভিলা) মেসে ভাড়া থাকেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী পারভেজ (১৮)। তার বাবা কামাল হোসেন গাজীপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাদের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। তিনি বলেন, পারভেজ ভোররাত সোয়া ৪টার দিকে আমাকে ফোন করেন। সে জানায় বাসায় গোলাগুলি হচ্ছে। বাইরে থেকে দরজা লাগানো। ওরা বের হতে পারছে না। এরপরই আমি গাজীপুর থেকে নাখালপাড়ায় চলে আসি।

পশ্চিম নাখালপাড়ার ৭৪ নম্বর বাড়ির মালিক ও ২৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, গত বছরের ১৪ আগস্ট এই বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালান। তখন অন্তত ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। শুনছি তারাও জঙ্গি। এরপর তাদের কী হয়েছে আর জানি না। তিনি বলেন, এসব কারণে আমাদের এলাকায় কোনও মেস ভাড়া দেইনা।

তেজাগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, গত বছর আমরা ওই বাসায় অভিযান চালিয়েছিলাম। তখন জামায়াত শিবিরের তিন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা ছিলো।