সর্বোচ্চ সতর্কতায়ও সহিংসতার শঙ্কা : দু’দলের পাল্টাপাল্টিতে উদ্বীগ্ন প্রশাসন

স্টাফ রিপোর্টার: খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় ঘিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি অবস্থানের র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও দেশের প্রধান দুদলের নেতাকর্মীরা সরাসরি সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়লে তা আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কি-না তা নিয়ে তারা সংশয়ে রয়েছেন। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে বিশেষ কোনো কৌশলে দু’দলের মধ্যকার টানটান উত্তেজনা নিরসন করা যায় কিনা র‌্যাব-পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা সে পথ খুঁজছেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা যায় কি-না তারা সে কথাও ভাবছেন।

এদিকে যে কোনো পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলার যাতে বড় ধরনের কোনো অবনতি না ঘটে এ জন্য বিজিবিকে (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মাঠে নামানোরও চিন্তা ভাবনা রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে এক্ষুনি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিয়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে তাদের রাজপথে নামানো না হলেও বেশ কয়েক প্লাটুন বিজিবি স্ট্যান্ডবাই রাখার বিষয়টি প্রশাসনিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

অন্যদিকে পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা কিংবা প্রকাশ্য হামলারও ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে আগাম সতর্ক করা হয়েছে। এরইমধ্যে পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যদের নিরাপদে থেকে দায়িত্ব পালন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের অস্ত্র-গোলাবারুদ কেউ যাতে কোনোভাবে ছিনিয়ে নিতে না পারে সে ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতর সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করেছে।

৮ ফেব্রুয়ারির আগেই ওইদিনের উত্তাপ কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আগাম দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থানে পুলিশের ভূমিকা কী হবে তা-ও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কোনো সদস্য যাতে অতিউৎসাহী হয়ে কারও পাতানো কোনো ফাঁদে পা না দেয় সে ব্যাপারেও সবাইকে সতর্ক করেছে প্রশাসন। ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ যে-ই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ুক না কেন, পুলিশ সহজেই কোনো অ্যাকশনে যাবে না। বরং এ ধরনের পরিস্থিতি আগেভাগে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে তারা। রাজপথে প্রতিপক্ষ দু’দল যাতে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ না পায় সেদিকেও নজর রাখবে পুলিশ। তবে কোনো ধরনের হামলা-পাল্টা হামলায় জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির কোনো আশঙ্কা থাকলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশকে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, এমনকি প্রয়োজনে গুলি ছুড়তেও নির্দেশ দেবে প্রশাসন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে সারাদেশে প্রায় ৮০ হাজার পুলিশ ফোর্স রণপ্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামবে। এদিকে পুরান ঢাকার বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতের চারদিকে জলকামান ও রায়টকারসহ অত্যাধুনিক নানা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সোয়াতের পাশাপাশি বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফোর্স দিনভর পাহারা দেবে। খালেদা জিয়ার বনানীর বাসভবন থেকে আদালতে আসা-যাওয়ার পুরো পথের দুধারে সাজ সাজ নিরাপত্তা পাহারা বসবে। তার আদালতে যাওয়ার পথে যানজট কিংবা অন্য কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা যাতে সৃষ্টি না হয় পুলিশ সেদিকেও খেয়াল রাখবে।

এদিকে ৮ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে রাজপথে উত্তাপ ছড়াতে রাজধানীর বাইরের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা যাতে ঢাকায় ঢুকতে না পারে সেদিকে আগে থেকেই নজর রাখতে শুরু করেছে পুলিশ। ডিএমপির ডিসি পদমর্যাদার দু’জন কর্মকর্তা জানান, এরইমধ্যে সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ও কমলাপুর রেলস্টেশনে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। সন্দেহজনক কাউকে দেখামাত্র তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি রাজধানীর আবাসিক হোটেলগুলোতে নিয়মিত তল্লাশি অভিযান চলছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেড়াতে আসা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খোঁজখবর রাখতে থানাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দায়িত্বশীল ওই দুই কর্মকর্তা জানান, ৮ ফেব্রুয়ারি যতোই ঘনিয়ে আসবে এসব তৎপরতা ততোই জোরদার হবে। পথে পথে তল্লাশি চৌকির সংখ্যাও বাড়বে। সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের সংখ্যাও বেশখানিকটা বৃদ্ধি পাবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সূত্রগুলো জানায়, দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের রায় যা-ই হোক না কেন তাতে যেন কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়- এটাই তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই সে টার্গেট সামনে রেখে পুলিশ সামনের দিকে এগোচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দারা এ সংক্রান্ত নানা আগাম তথ্য সংগ্রহ করছে।

বিশেষ করে ৮ ফেব্রুয়ারি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক রায় হলে বিএনপি কী ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, কারা-কীভাবে এতে অংশ নেবে- সে সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছে। একই সঙ্গে বিএনপিকে মোকাবেলায় আওয়ামী লীগের কোনো আক্রমণাত্মক ছক রয়েছে কিনা গোয়েন্দারা তা-ও খুঁজে দেখছে।

দায়িত্বশীল একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, বিএনপি-আওয়ামী লীগের অ্যাকশন প্লান বুঝেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা ছক সাজাবে। তারা তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করলে পুলিশও সে দিকে এগোবে। তবে সবকিছুর আগে পুলিশ জনগণ ও নিজেদের জানমালের দিকে লক্ষ্য রাখবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, হাইকোর্টের সামনে প্রিজনভ্যান থেকে বিএনপির আটক দুই কর্মীকে ছিনিয়ে নেয়া এবং পুলিশের ওপর হামলা ও তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ভেঙে ফেলার বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে ৮ ফেব্রুয়ারির নিরাপত্তা ব্যবস্থার ছক সাজানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি দুর্বৃত্তদের নাশকতার প্রস্তুতি, হামলার ধরন ও স্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে তৎপর থাকতে গোয়েন্দাদের তাগিদ নেয়া হয়েছে। যাতে কেউ নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনো সুযোগ না পায়।

এদিকে ওইদিন যানবাহন চলাচলে বাধাসহ সব ধরনের পিকেটিং ঠেকাতে নির্বিচারে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ এমনকি প্রয়োজনে রাবার বুলেট চালাতেও পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি যাতে কেউ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামতে না পারে সেজন্য স্পর্শকাতর পয়েন্টগুলোতে জলকামানের পাশাপাশি রায়টকার এবং চাহিদা অনুযায়ী আর্মস ফোর্স ও দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কেউ রাস্তায় নামলেই গ্রেফতার, এমনকি ৩-৪ জনের অধিক বেআইনি সমাবেশ হলেই ধরপাকড়ের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।

ডিএমপি সূত্র জানায়, ৮ ফেব্রুয়ারির নিরাপত্তায় মেট্রোপলিটন এলাকায় ভোর থেকে ডিএমপির প্রায় সাড়ে ৯ হাজার পোশাকধারী ফোর্স ও ১ হাজার রিজার্ভ ফোর্সসহ প্রায় ১৩ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। এছাড়া টহলে থাকবে র‌্যাবের প্রায় দুই হাজার সদস্য। দাঙ্গা ফোর্সের পাশাপাশি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), সোয়াত টিম ও বোম ডিস্পোজাল টিমকে ৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে ‘ওয়ার্মআপ’ রাখা হবে। দাঙ্গা পুলিশের প্রতিটি ইউনিটে পর্যাপ্ত টিয়ারশেল মজুদ নিশ্চিত করা হয়েছে। অধিকতর স্পর্শকাতর পয়েন্টগুলোতে জলকামান ও রায়টকার মোতায়েন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে রণকৌশলে তৈরি করা হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ছক।

এছাড়াও মাঠে নামবে ডিবিসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রায় এক হাজার সদস্য। তারা সাদা পোশাকে নগরীর ব্যস্ততম সড়কসহ বিভিন্ন অলিগলিতে টহল দেবে। কোনো ধরনের নাশকতায় সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন কাউকে দেখামাত্র তারা অ্যাকশনে যাবে।

অন্যদিকে যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে নগরীর রাস্তায় নামবে পুলিশের বিশেষ টিম। এছাড়া দোকানপাট ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় প্রতিটি মার্কেট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রে বিপুলসংখ্যক ফোর্স মোতায়েন থাকবে। স্ট্যান্ডিং ফোর্সের পাশাপাশি নগরীতে টহল দেবে র‌্যাব ও পুলিশের টহল টিম।

এদিকে নাশকতার আশঙ্কায় ৮ ফেব্রুয়ারি ও এর আগেপরে নগরীতে গণপরিবহন চলাচল সীমিত থাকবে বলে অনেকেই ধারণা করছে। তবে কেউ কেউ বলছে, বিএনপির শোডাউন বন্ধ করতে সরকারই এ ‘কৌশল’ হাতে নেবে।

তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি সব রুটেই পর্যাপ্ত গাড়ি চলবে। কেউ কোনো গণপরিবহনে হামলা চালানোর চেষ্টা করলে বিগত সময়ের মতো পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সম্মিলিতভাবে তাদের প্রতিহত করবে। ওইদিন ঘিরে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান এ পরিবহন নেতা।