বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় ঘিরে দেশব্যাপী উত্তেজনা

জামাত-বিএনপির নেতাকর্মী ধরপাকড় : চুয়াডাঙ্গায় গ্রেফতার ৪৭
ঝিনাইদহের বিভিন্নস্থানে গোপন বৈঠকে পুলিশের হানায় গ্রেফতার ৭০ : বোমা ও ককটেল উদ্ধার
মাথাভাঙ্গা ডেস্ক: বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গণে অস্থিতিশীলতার শঙ্কায় চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহসহ দেশব্যাপী চলমান অভিযানে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পেশাদার ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও মাদকব্যবসায়ীসহ কিছু চিহ্নিত অপরাধী আদালত থেকে ছাড়া পেলেও বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থক কারও জামিন হয়নি। বরং কারাবন্দি পুরোনো নেতা-কর্মী কেউ জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বের হলে তাকে ফের আটক করে নতুন মামলায় আসামি দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হচ্ছে। গত ২৫ জানুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণের পর থেকে এ অবস্থা চলছে বলে বিএনপির প্রথম সারির নেতারা অভিযোগ করেছেন। তাদের ভাষ্য, সুনির্দিষ্ট মামলা না থাকলেও অভিযানে আটক বিএনপির নেতা-কর্মীদের পুলিশ সন্দেহভাজন নাশকতাকারী কিংবা মহানগর অধ্যাদেশ বা বিশেষ কোনো ধারায় চালান দিচ্ছে। আর সেখান থেকে জামিন নামঞ্জুর করে আদালত তাদের কারাগারে পাঠাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গায় বিএনপি ও জামায়াতের ১৫ জন নেতা-কর্মীসহ ৪৭ জনকে আটক করেছে পুলিশ। গত রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত পুলিশ জেলার ৪ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে। নাশকতা ও নাশকতার চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রদলের সদস্য আশিকুর রহমান শিপুলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল দুপুরে চুয়াডাঙ্গা সদর ফাঁড়ির এএসআই আল ইমরান তাকে গ্রেফতার করেন। শিপুল চুয়াডাঙ্গা শহরের সবুজপাড়ার রিকাত আলীর ছেলে।
চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার সন্ধ্যা থেকে গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত জেলার ৪ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে নাশকতা, নাশকতার চেষ্টাসহ বিভিন্ন মামলার ৪৭ আসামীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর থানা ১০ জন, দামুড়হুদা মডেল থানা ১২ জন, জীবননগর থানা ১০ জন ও আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ ১৫ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৫ জন বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী এবং বাকিরা বিভিন্ন মামলার আসামি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে নাশকতা মামলার ৪ জামায়াত ও ২ বিএনপি নেতাকে আটক করেছে। গতপরশু রাতে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করে নিয়ে আসে।
পুলিশসূত্রে জানা গেছে, উপজেলার জামজামি উত্তরপাড়ার ওয়াসেল আলীর ছেলে ওয়ার্ড জামায়াত ইসলামের সদস্য শহিদুজ্জামান হায়দার (৫০), উপজেলার আলীয়াটনগরের মৃত জয়নাল আলীর ছেলে ওয়ার্ড জামায়াত ইসলামের সদস্য হেলাল উদ্দিন (৪০) কুমারী দুর্লভপুর গ্রামের মৃত আকাইলে ম-লের ছেলে ওয়ার্ড জামায়াত ইসলামের সদস্য আব্দুল মজিদ (৪০), নওদা-দুর্গাপুর গ্রামের মৃত ভেরম ম-লের ছেলে ওয়ার্ড জামায়াত ইসলামের আব্দুর রহমান (৫৫)। একই মামলার উপজেলার জামজামি গ্রামের মৃত ভিকু শাহার ছেলে বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন মেম্বার (৫০) ও শিবপুর গ্রামের হায়দার আলীর ছেলে বিএনপি নেতা মমিন আলীকে আটক করে নিয়ে আসে। গতকাল তাদেরকে নাশকতা মামলায় আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
দর্শনা অফিস জানিয়েছে, কয়েকদিনের গ্রেফতার অভিযানে দামুড়হুদা থানা পুলিশ কয়েকজন বিএনপি নেতাকে গ্রেফতার করেছে। চলমান এ অভিযানে চরম আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে নেতারা। দামুড়হুদা থানা পুলিশ গতকাল সোমবার বিকেলে অভিযান চালিয়ে দর্শনা মোবারকপাড়ার আলী হোসেনের ছেলে জেলা ছাত্রদলের সদস্য নাসির উদ্দিন হাসুকে (২৪) গ্রেফতার করেছে। দিনভর পুলিশি অভিযানে কয়েকজন বিএনপি নেতাকে ধাওয়া করেও গ্রেফতার করতে পারিনি পুলিশ। দামুড়হুদা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আকরাম হোসেন বলেছেন, গ্রেফতারকৃত নাসির উদ্দিন হাসু দর্শনাসহ বিএনপি জামায়াতের অনেক নেতাকর্মী ইতঃপূর্বে নাশকতামূলক কর্মকা-ে জড়িত ছিলো এবং আগামীতে এ ধরনের কর্মকা-ের পরিকল্পনা করছিলো। নাশকতামূলক কর্মকা-ের অভিযোগে হাসুকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দামুড়হুদা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদায় নাশকতামূলক কর্মকা- ঘটাতে পারে এমন তথ্যের ভিত্তিতে ধরপাকড় অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। উদ্ধার করা হয়েছে ভারতীয় তৈরি ৪০ বোতল ফেনসিডিল। ধর-পাকড় অভিযানে জামায়াত বিএনপির ৫ নেতা-কর্মীসহ ১৩ জনকে আটক করেছে পুলিশ। গত রোববার রাতে এবং গতকাল সোমবার তাদেরকে আটক করা হয়। আটককৃতরা হলেন- দামুড়হুদা উপজেলা বিএনপির যুগ্মসম্পাদক ডুগডুগির ইউসুফ আলী (৪৮), নাটুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি চারুলিয়ার সামসুল আলম মেম্বার (৫৮), বিএনপি নেতা জগন্নাথপুরের আমির হোসেন (৬২), চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রদলের সদস্য দর্শনা মোবারকপাড়ার হোসেন আলীর ছেলে নাসির উদ্দীন খান (৩২), চ-িপুরের জামায়াতকর্মী আইনদ্দীন মোল্লার ছেলে সেলিম মোল্লা (৫০), পারকৃষ্ণপুরের শাহার আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম (৩৫), মদনা গ্রামের বাক্কার ছেলে আরিফ হোসেন (৩৬), কুতুবপুরের মুছা করিমের ছেলে আবু সিদ্দিক, একই গ্রামের মক্কর আলীর ছেলে জিয়াউদ্দীন, দর্শনা দক্ষিণ-চাঁদপুরের আবুল কাশেমের ছেলে লাভলু (২৬), ঈশ্বরচন্দ্রপুর গ্রামের শামছদ্দিনের ছেলে শাহার আলী (২০), একই গ্রামের ফারুক হোসেনের ছেলে রফিকুল ইসলাম (২০) এবং হরিরামপুরের সিরাজুল ইসলামের ছেলে আনারুল ইসলাম। দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ আকরাম হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, নাশকতামূলক কর্মকা- ঘটাতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া ভগিরথপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এএসআই শাহাবুদ্দিন সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে অভিযান চালিয়ে হরিরামপুরের সিরাজুল ইসলামের ছেলে আনারুলকে ৪০ বোতল ফেনসিডিলসহ ভগিরথপুর বাজার মোড়স্থ কালামের চায়ের দোকানের সামনে থেকে আটক করা হয়।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় পুলিশের বিশেষ অভিযানে বিএনপি-জামায়াতের ৬ নেকা-কর্মীকে গ্রেফতার হয়েছে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে ঘিরে এ গ্রেফতার অভিযান চলছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরমভাবে গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিএনপি-জামায়াতের অধিকাংশ নেতা-কর্মী গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছে।
জীবননগর থানা পুলিশ গত রোববার গভীররাত হতে গতকাল সোমবার পর্যন্ত উপজেলা বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে বিএনপি জামায়াতের ছয় নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত হলেন- হাসাদহ ইউনিয়ন বিএনপি নেতা আবুল হাসান (৫০), মিজানুর রহমান (৪৬), যুবদল নেতা কাজী সুমেন শান্ত (৩০), আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর জিল্লুর রহমান (৫০), বিপুল হোসেন (৪৬) ও মুক্তারপুরের শহিদুল ইসলাম (৫৫)। পুলিশের বলছে গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে।
জীবননগর থানার অফিসার ইনচার্জ মাহমুদুর রহমান বলেন, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। ওই রায়কে ঘিরে যারা মূলত এলাকায় নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আমরা শুধু তাদেরকে গ্রেফতার করছি। তিনি ৬ জনকে গ্রেফতারের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঝিনাইদহে নাশকতা বিরোধী বিশেষ অভিযানে বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীসহ ৬৯ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এ সময় উদ্ধার করা হয় ৭টি ককটেল। গত রোববার রাত থেকে গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, জেলায় নাশকতা বিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। এ অভিযানের অংশ হিসেবে জেলার ৬টি উপজেলা থেকে বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মী সহ ৬৯ জনকে আটক করা হয় এবং উদ্ধার করা হয় ৭টি ককটেল। এর মধ্যে সদর উপজেলাতে ২০, শৈলকুপায় ১৫, হরিণাকু-ুতে ৫জন, কালীগঞ্জ থেকে ৫ জন, কোটচাঁদপুরে ২২ এবং মহেশপুর থেকে ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা বিভিন্ন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদিকে গেলরাতে ঝিনাইদহ সদর থানার নাশকতার মামলায় জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও হরিণাকু-ু উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাড. এমএ মজিদকে যশোর বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়।
কোটচাঁদপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কোটচাঁদপুরের পল্লিতে গতকাল সোমবার রাতে জামায়াতের গোপন বৈঠক চলাকালে পুলিশ সেখানে হানা দিয়ে ১৫টি হাত বোমাসহ দুই জামায়াত নেতাকে আটক করে। এছাড়া সাবদারপুর ইউপি বিএনপি সভাপতিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কোটচাঁদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ বিপ্লব কুমার সাহা জানান, উপজেলার এলাঙ্গী ইউপির চাদপাড়া গ্রামে নাশকতার উদ্দেশে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সমবেত হবার সংবাদ পেয়ে পুলিশ ওই গ্রামে রাত সোমবার সোয়া ১০টার দিকে হানা দেয়। চাদপাড়া জামে মসজিদের পেছনে জনৈক আলতাফ বিশ্বাসের আমবাগানে জামায়াতের ৩০-৩৫ জন নেতা-কর্মী সেখানে বৈঠক করছিলো। পুলিশ সেখান থেকে রোকুনজ্জামান ডাবলু ও হাশেম আলী নামে দুই জামায়াত নেতাকে ১৫টি হাত বোমাসহ আটক করে। এছাড়াও পুলিশ সাবদারপুর ইউপি বিএনপি সভাপতি মিজানুর রহমানকে আটক করেছে।
মহেশপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঝিনাইদহের মহেশপুরে সন্ত্রাস ও নাশকতা করার উদ্দেশে গোপন বৈঠক করার সময় ককটেল, লিফলেট, লাঠিশোঠাসহ ১২জনকে আটক করেছে মহেশপুর থানা পুলিশ। থানাসূত্রে প্রকাশ, গতকাল সোমবার দিবাগত রাত্রে উপজেলার এসবিকে ইউনিয়নের কাঁকিলাদাড়ী যাত্রী ছাউনির কাছে সন্ত্রাস ও নাশকতা করার উদ্দেশে গোপন বৈঠক চলছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে মহেশপুর থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করে। আটককৃতরা হলেন তালসার গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে মোহাম্মদ আলী (৫০), সামন্তা গ্রামের মৃত মোবারক মালিতার ছেলে মকসেদ আলী(৫০), বাগদির আইট গ্রামের মৃত ইছারত আলীর ছেলে আসাদুজ্জামান (৪০), রামচন্দ্রপুর গ্রামের উসমান আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম (২৬), একই গ্রামের লিয়াকত বিশ্বাসের ছেলে বাবুল হোসেন (২২), মৃত নুর মোহাম্মদের ছেলে সুমন হোসেন (২৩), খালিশপুর গ্রামের ইউসুফ আলীর ২ ছেলে জিনারুল (৩৬) ও রেজাউল (৪৫), বজরাপুর গ্রামের মৃত মুনসুর আলীর ছেলে শওকত আলী (৩৮), মালাধারপুর গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে জহুরুল ইসলাম (২৩), একই গ্রামের হাজি আব্দুল মালেকের ছেলে ইউনুস আলী (৩৬) ও আব্দুল মালেক সর্দারের ছেলে তাইজুল ইসলাম সর্দার (৫৯)। এ বিষয়ে মামলার বাদী এসআই বজলুর রহমান বলেন, ওই আসামিরা নাশকতা করার উদ্দেশে গোপন বৈঠক করছিলো এমন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করা হয়। গতকাল সোমবার দুপুরে তাদেরকে ঝিনাইদহ আদালতে পাঠানো হয়েছে।