বুকে নিয়েছে অসংখ্য মানুষের লাশ :চন্দ্রাবতীর রয়েছে মর্মান্তিক ইতিহাস

চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়কে বোয়ালমারী গ্রামে নিরবে কালেরস্বাক্ষী হয়ে আছে চন্দ্রাবতী ইদারা

খাইরুজ্জামান সেতু: চন্দ্রাবতী ইদারা! কালেরস্বাক্ষী হয়ে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়কে বোয়ালমারী গ্রামে। শহর থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে। পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় ইদারাটি ইতিহাস বহন করছে। ইদারার বেষ্টনীতে থাকা ফলক অনুযায়ী, পরিবেশ রক্ষা কল্পে এটি ১৯২১ সালের দিকে খনন করে বিএম নীলমনিগঞ্জ রোটারী ভিলেজপার্ক-১। পরিবেশ রক্ষা কল্পে ইদারাটি স্থাপন করা হলেও বুকে নিয়েছে অসংখ্য মানুষের লাশ। জনশ্রুতি রয়েছে বিভিন্ন সময়ে এ সমস্ত এলাকায় সন্ত্রাসীরা কাউকে হত্যা করার পর লাশ এই ইদারাতে নিক্ষেপ করতো। সর্বশেষ জেলার পৌর এলাকার হাজরাহাটি গ্রামের মেয়ে মিনুআরাকে তার স্বামীসহ ৩ যুবক ধর্ষণ শেষে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ফেলে রাখে এ ইদারার মধ্যে। পরে সেই ৩ ধর্ষকদের বিজ্ঞ আদালত মৃত্যুদ- কার্যকর করার রায় দেয়। ইদারাটি দেখেছে অসংখ্য মানুষের তাজা রক্ত।
এছাড়াও এ ইদারা নিয়ে আছে এক মর্মান্তিক ইতিহাস। এক সময় বোয়ালমারী নীলমণিগঞ্জ, হাজরাহাটিসহ আশপাশ গ্রামের চাষিরা বিস্তৃতমাঠে চাষাবাদ করার সময় খাবার পানির অভাবে পিপাসায় কাতর হয়ে পার্শ্ববর্তী নবগঙ্গার দূষিত পানি পান করতো। এতে ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা ধরনের পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাতো। প্রায় ১শ’ বছর পূর্বে কৃষকদের পানির পিপাসা দূর করার জন্য ‘চন্দ্রাবতী’ নামে এক পতিতার টাকায় এ ইদারা (ইন্দারা) খনন করা হয়। কে এই ‘চন্দ্রাবতী’, কি তার পরিচয় খুজতে গিয়ে এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান আমাদের বাপ দাদাদের কাছ থেকে শুনেছি প্রায় ২শ’ বছর আগে কুলচারা গ্রামে বসবাস করতো গোয়ালারা। তাদের ছিলো এক অপরুপ সুন্দরী মেয়ে। তার নাম চন্দ্রাবতী। গোয়ালারা ছিলো ধনী। ছিলো অঢেল টাকা-পয়সার মালিক। আর এই টাকা-পয়সার লোভে তাদের বাড়িতে হানা দেয় এক দল ডাকাত। ধনরতœ লুট করার পাশাপাশি তাদের সুন্দরী মেয়ে চন্দ্রাবতীকে তুলে নিয়ে যায়। ডাকাতরা চন্দ্রাবতীকে পরে তার বাড়ি সম্মানের সাথে পৌঁছে দেয়। তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ভয়ে তার বাবা তাকে আশ্রয় দেয়নি। বাড়ি থেকে বের হয় অপরুপ সুন্দরী চন্দ্রাবতী। পড়ে এক নরপিচাশ চক্রের হাতে। তারা ইচ্ছামত তার দেহ উপভোগ করে। সর্বশেষ তাকে পতিতার কাজ করতে বাধ্য করে। হাত বদল হতে হতে সে এক জমিদার বাবুর কাছে আশ্রয় পায়। মরার পূর্বে জমিদার বাবু তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে যায়। এভাবে ৩০ বছর পার হয়ে যায়। যৌবনও শেষ হয়ে আসে তার। মন-মানসিকতার পরিবর্তন হতে থাকে চন্দ্রাবতীর। চন্দ্রাবতী তখন ভাবতে থাকে মৃত্যুর কথা। এই সময় তার মনের ভেতর ভয় কাজ করতে থাকে। যত পাপ কাজ করেছে তার কি ক্ষমা আছে? এর কোনো সদুত্তর না পেয়ে তিনি এলাকার সমাজপতিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকে। অবশেষে হাজরাহাটি গ্রামের দানেজ ও নেহাল বিশ্বাস তাকে তওবা করে মুসলমান হওয়ার জন্য উপদেশ দেন। অবশেষে তাদের পরামর্শে সে বোয়ালমারী মসজিদের ইমামের কাছে যেয়ে তওবা করে মুসলমান হয়। এরপর চন্দ্রাবতী আর পাপ করবে না ভেবে পুণ্য করার কথাভাবে। সেই ভাবনা থেকেই মাঠে কৃষকদের পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য জমি ক্রয় করে ইন্দারা খনন করে দেয়। সাথে বিশ্রামের জন্য একটা ঘর করে দেয়। মাঠের চাষিরা জমি চাষ করে ক্লান্ত হয়ে এখানে বসে পিপাসা দূর করতো। চন্দ্রাবতী নেই। জরাজীর্ণ অবস্থায় তার খনন করা ইন্দারা পড়ে আছে নিরবে কালের স্বাক্ষী হয়ে।