লোকসান জেনেও নিজ খরচে আখ পাঠানো হচ্ছে মোবারকগঞ্জ চিনিকলে

?

দূরদর্শিতার অভাবে দর্শনা কেরুজ চিনিকলের টন টন আখ মাঠে রেখে ২০১৭-১৮ মরসুম বন্ধ ঘোষণা

নজরুল ইসলাম: কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শীতার কারণে দিন দিন দিন লোকশানের বোঝা ভারি হচ্ছে চিনিকলটির। নিজের খেয়াল খুশিমতো পরিচালিত হচ্ছে সবকিছু। যে কারণে জেলার একমাত্র মূল্যবান সরকারি চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠানটি পড়েছে হুমকির মুখে। জেনে শুনে করা লোকশানের দায়ভার নেবে কে এ প্রশ্ন সচেতন মহলের। না-কি পরিকল্পিতভাবে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠনটি ধ্বংসের নীল নকশা আটা হয়েছে। যার কারণে চিনিকল বন্ধের ১২ দিন পরও নিজ খরচে আখ সরবরাহ করা হচ্ছে মোবারকগঞ্জ চিনিকলে।
চিনিশিল্পের একমাত্র কাঁচামাল হচ্ছে কাঁচা আখ। আখের চাষ বৃদ্ধির পাশাপাশি চিনিশিল্পকে বাঁচাতে বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছে নানামুখি উদ্যোগ। যার কারণে আখ চাষে চাষিদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে চালানো হয়েছে প্রচার প্রচারণা। উদ্দেশ্য আখের অভাবে মাড়াই মরসুম যেনো কোনোভাবেই ব্যহত না হয়। সে জন্য চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের আখ চাষ বাধ্যতা অনেকটায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এমনকি আখ চাষ না করলে চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে যাবার কথা পর্যন্ত শুনতে হয়েছে শ্রমিক-কর্মচারীদের। তাইতো করপোরেশনের চেয়ারম্যান দফায় দফায় এলাকাতে এসে আখ চাষ বাড়ানোর জন্য চাষিদের নিয়ে করছেন সভা-সমাবেশ। অথচ টন টন আখ মাঠে রেখে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ২০১৭-১৮ মাড়াই মরসুম বন্ধ করে ঘোষণা করেছে গত মাসের ২১ ফেব্রয়ারি। বন্ধের ১২ দিন অতিবাহিত হলেও ৩-৪ দিন ধরে চিনিকল কর্তৃপক্ষ অনেকটায় শুকনা আখ নিজ খরচে কেটে এবং পরিবহণ খরচে মোবারকগঞ্জ চিনিকলে পাঠাচ্ছে। যে আখ মোবারকগঞ্জ চিনিকলে পাঠাচ্ছেন তা থেকে যে চিনি উৎপাদন হবে তা লাভের চাইতে লোকসান হবে কয়েকগুণ। লোকসান জেনেও এমন সিদ্ধান্ত নেয়া কতোটা যোক্তিক? না-কি আখ কাটা খরচ, পরিবহণ খরচ দেখিয়ে কারও কারও পকেট করছে ভারী। চিনিকল কর্তৃপক্ষ অবশ্য শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যুক্তি খাড়া করছে যে আখ মোবারকগঞ্জ চিনিকলে এখন পাঠাচ্ছে সেই আখ চাষিদের জন্য বীজ রাখা হয়েছিলো। আখ চাষে চাষিরা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় বাধ্য হয়ে লোকশান জেনেও সে আখ এখন মোবারকগঞ্জে পাঠানো হচ্ছে।
এদিকে চিনিকলসূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১ ডিসেম্বর দর্শনা কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ ২০১৭-১৮ আখ মাড়াই মরসুমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এবং ২১ ফেব্রুয়ারি মাড়াই মরসুম আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করেন। যদিও চলতি মরসুমে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বেধে দেয়া নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৭০ মাড়াই দিবসে ৮০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৫ হাজার ৮শ মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন। যেখানে চিনি আহরণের গড় হার নির্ধারণ করা হয়েছিলো ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। অথচ চলতি মরসুমে চিনি আহরণের গড় হার অর্জন হয়েছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও পৌছুতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। সেই সাথে ৭৮ হাজার ৫৩০ মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন হবে ৪ হাজার ২শ মেট্রিকটন। ফলে নির্ধারিত উৎপাদনের ক্ষেত্রে ৪৭০ মেট্রিকটন আখমাড়াই যেমন কম হয়েছে তেমনই চিনি উৎপাদনও কম হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬শ মেট্রিকটন। আর লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে ১৩ দিন। চলতি মরসুম আখ মাড়াই এবং চিনি উৎপাদনে সকল হিসেব নিকেশ হ-য-র-ল-ব অবস্থায় পরিণত হয়েছে। হিসেব নিকেস ১৮-২০ হতে পারে। তাই বলে ১০-২০ হতে পারে না। আর যদি সেটাই হয় তাহলে যারা এ গড়মিলের হিসাব উপস্থাপন করবেন তারা যে অদক্ষ তা সহজেই অনুমেয়। যা এবার চিনিকলে ঘটেছে। চলতি মরসুমে অন্যান্যবারের মতো বড় ধরণের ত্রুটির কবলে পড়তে হয়নি চিনিকলটিকে। তারপরও লোকশানের বোঝা দিন দিন ভারীই হচ্ছে। এর মূল কারণই বা কি আর সমাধনই বা কি? তাইতো কেরুজ চিনিকল বন্ধের ১২ দিন পরও নিজ খরচে ঝোপঝাড়সহ শুকনা আখ মোবারকগঞ্জ চিনিকলে আখ সরবারাহ করছে কর্তৃপক্ষ। যে আখ খড়ি করে বিক্রি করলেও হয়তো চিনিকল কর্তৃপক্ষের কিছু পয়সা ঘরে উঠতো। চিনিকলের একজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চাষিদেরকে বলা হচ্ছে চিনিকলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আখ আনতে। অথচ নিজেদের আখ আনা হচ্ছে পুড়িয়ে অথবা ঝোপঝাড়সহ। শুধু আখেই না এবছর দিনাজপুর থেকে খড়ি এনে বয়লার চালানো হয়েছে। যেখানে খড়ির চাইতে পরিবহণ খরচ পড়েছে অনেক বেশি। জেনেশুনে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তে লোকশান গুণছে তার দায়ভার নেবে কে?
এ ব্যাপারে কেরুজ চিনিকলের ফার্ম ম্যানেজার হুমায়ুন কবির বলেন, চাষিদের চাহিদা মাথায় রেখে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে বীজ আখ রাখা হয়েছিলো। চাষিদের বীজ আখের চাহিদা না থাকায় সে আখ চিনিকলের খরচে মোবারকগঞ্জ চিনিকলে পাঠানো হচ্ছে। এর ব্যাখা আমার জানা নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। আর প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে শুধু কেরুতে না সব চিনিকলেই আহরণের মাত্রা কম হয়েছে।