৭ মার্চের অবমাননা ও তরুণী ছাত্রী নিগ্রহ

৭ মার্চের মতো একটি ঐতিহাসিক এবং মহান দিবসে ঢাকার রাজপথে তরুণী ছাত্রী নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। সেজন্যে বিশেষভাবে কাউকে দায়ী করা বা নিন্দা জানানোর জন্য আজকের এই লেখাটা লিখছি না। যেসব দুর্বৃত্ত (দুর্বৃত্ত বললেও কম বলা হয়) এই কাণ্ড ঘটিয়ে ৭ মার্চের অবমাননা, নারীত্বের অবমাননার সঙ্গে মনুষ্যত্বের অবমাননা করেছে তাদের নিন্দা করে এবং শাস্তি দাবি করে দায়িত্ব শেষ করতে চাই না। সরকারকে এবং ক্ষমতাসীন দলকেও তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য সমালোচনা করতে চাই না। শুধু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই ‘ওহে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি, এ আমার, তোমার পাপ’।

যদি নিন্দা করতে হয়, তবে নিজেদেরই অকপটে নিন্দা জানাতে হবে। বিশ্বময় আত্মঅবক্ষয়ের এক ভয়াবহ যুগে আমরা বাস করছি। এই সভ্য যুগে উন্নত অনুন্নত নির্বিশেষে সকল দেশে চলছে এই অবাধ নারী নিগ্রহ। পশ্চিমবঙ্গের শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিপূত শিক্ষা-আশ্রমে তরুণী ও সুন্দরি নারীরা এখন নিরাপদ নয়। পৌষমেলা, মাঘী মেলায় যোগ দিতে গিয়ে ছাত্রীরা অসভ্য আচরণের, এমনকি ধর্ষণেরও শিকার হয়। বিশ্বভারতীর শিক্ষকেরাও ছাত্র সমাজের মধ্যে এই যৌন অপরাধের বিস্তার ঠেকাতে পারছেন না।

এ যুগের শিক্ষার অতি উচ্চ পাদপীঠ অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত ছাত্রী নিগ্রহের ডেট রেপিংয়ের সংখ্যা বাড়ছে। সহপাঠী ছাত্রীকে কোনো পাবে মদ পানের আমন্ত্রণ জানিয়ে কৌশলে তার গ্লাসে মাদক মিশিয়ে দিয়ে নিজ কক্ষে নিয়ে রাতভর ধর্ষণের কাহিনিও লন্ডনের কাগজে প্রায়শই প্রকাশিত হচ্ছে। এই ডেট-রেপিংয়ের অনুকরণের বিস্তার চলছে ভারতের বড় বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই রোগ যে বাংলাদেশেও ছড়ায়নি তা নয়। জন্মদিনের পার্টিতে বান্ধবীকে বা সহপাঠিনী কোনো ছাত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে শুধু একক ধর্ষণ নয়, সংঘবদ্ধ ধর্ষণেরও একাধিক খবর ঢাকার কাগজেই পড়েছি।

ঢাকায় ৭ মার্চের নারী নিগ্রহের ঘটনা আরো লজ্জাকর। এটা জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে কৌশলে নারী নিগ্রহ নয়, অথবা বাড়িতে অথবা কোনো নির্জন স্থানে সুযোগ পেয়ে নারীর সঙ্গে অশ্লীল আচরণের চেষ্টা নয়। এটা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের (যা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে) স্মৃতিপূত দিবস উদযাপনের সমাবেশে যাওয়ার মিছিল থেকে বেরিয়ে এসে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী একাধিক ছাত্রীর উপর হামলা ও তাদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা।

বিশ্ববিদ্যালয়গামী এক ছাত্রীর গায়ে পানি ঢেলে তাকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা হয়েছে এবং কলেজগামী এক ছাত্রীর কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলে দিনে-দুপুরে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। সাত মার্চের বিশাল সমাবেশ ও কনসার্টের দরুন রাস্তায় যানবাহন কম থাকায় এই তরুণীরা পায়ে হেঁটে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কলেজে যাচ্ছিলেন। এক নিগৃহীতা তরুণী তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি আর এই দেশে থাকতে চাই না, চাই না।’ এই আর্তি কি আমাদের রাষ্ট্র বা সমাজ-বিধায়কদের কারো মর্মে গিয়ে পৌঁছুবে?

এই ঘটনা শুধু ঢাকার ঘটনা নয়, মুম্বাই, দিল্লি, লন্ডন, বোস্টনের মতো অনেক শহরের ঘটনা। নিউ ইয়ার্স ডে এমনকি ক্রিসমাস ডে’র আনন্দ-উত্সবের দিনে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রীরা যৌন উত্পীড়নের শিকার হয়। শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে, ছাত্র সহপাঠিনীকে ধর্ষণ করে, এমনকি ধর্মযাজক ও একশ্রেণির পীর তাদের শিষ্য নারীদের ওপর উত্পীড়ন চালায়— এটাতো এখন একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। ভারতের কাগজে একটা খবর দেখেছি, একটি নামকরা মন্দিরে পূজা দিতে আসা একদল তরুণী মন্দিরের ভেতরেই সেবায়েতদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে।

সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মতো নারী নির্যাতনও একটি সামাজিক ব্যাধি। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পচন থেকে এর জন্ম এবং এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে সারা বিশ্বে এই পচনের প্রসার শুরু হয়েছে। সামাজিক অসুস্থতা দূর করা না গেলে এই পচনের কবল থেকে কোনো দেশেরই তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা যাবে না। সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিরা যে অপরাধগুলো করেন অথবা প্রশ্রয় দেন, পরবর্তী প্রজন্মে তা দ্রুত প্রসার লাভ করে।

এই বিশাল সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য কিছু অপরাধীকে ধরে এনে শাস্তি দিলে কিছু হবে না। মৃত্যুদণ্ড প্রবর্তন করে যেমন কোনো সমাজে গুম, খুন, ধর্ষণ বন্ধ করা যায়নি, তেমনি কিছু অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে তাদের অপরাধের মূলোত্পাটন করা যাবে না। অপরাধীকে যেমন শাস্তি দিতে হবে, তেমনই অপরাধের মূল উত্স খুঁজে বের করতে হবে। এটা বিশ্ব সমস্যা। বাংলাদেশ একা তা সামলাতে পারবে না, কিন্তু নিজের ঘর সামলাবার ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে। দুর্বৃত্তেরা যদি দলীয় লোক বা সমর্থক হিসেবে ধরা পড়ে তাহলেও যেন বিচার ও শাস্তি থেকে রেহাই না পায়।