মেহেরপুরের তিনটি নদী দখলে বিলিনের পথে

মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুর জেলার ৩টি নদী নাব্যতা সঙ্কটে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এ সুযোগে নদী দখল করে চাষাবাদ করছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। ফলে নাব্যতা সঙ্কট আরও বেড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নদীর আকার আকৃতি পরিবর্তনে নদীগুলো বিলিনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, মেহেরপুর জেলার প্রধান নদী ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কাজলা ও ছেউটিয়া। গত বছর ভৈরব নদীর ২৯ কিলোমিটার পুনর্খননের ফলে নদী স্বরুপে ফিরেছে। বাকি তিনটি নদী দীর্ঘদিন ধরে পুনর্খনন হয়নি। গত বছর এসব নদীতে কাক্সিক্ষত পানির দেখা মেলে। বর্ষার প্রথম থেকেই পর্যাপ্ত বৃষ্টির কারণে নদী-নালা খাল-বিল এখন টইটুম্বর ছিলো। ফলে স্থানীয় হাট বাজারে স্বল্প পরিমাণে হলেও দেখা মিলছে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। কিন্তু শুষ্ক মরসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নদীগুলো দখল করে আবাদ করছেন এলাকবাসী। ফলে দেশীয় মাছ ও জলজপ্রাণি হুমকির মুখে পড়েছে।
জানা গেছে, ভৈরব নদ সদর ও মুজিবনগর উপজেলায়, মাথাভাঙ্গা, কাজলা ও ছেউটিয়া নদী গাংনী উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। ভৈরবনদ ও মাথাভাঙ্গা নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতে। গাংনী উপজেলার কাজিপুর ও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার তেকালা গ্রামের মাঝ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মাথাভাঙ্গা নদী। গাংনী ও দৌলতপুর উপজেলার সীমারেখার মাঝ দিয়ে হাটবোয়ালিয়া এলাকা হয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলায় প্রবেশ করে ভৈরব নদের সাথে মিশেছে। এই নদী গাংনী, দৌলতপুর ও কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কৃষকের এক সময়ের চাষের প্রধান পানির উৎস ও মাছের আঁধার ছিলো। শুষ্ক মরসুমে ভারত থেকে আর পানি আসে না। ফলে নদী শুকিয়ে যায়। কোথায় কোথায় অল্প পানি থাকলেও সেখানে কোমর বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। ফলে নদীর ¯্রােত বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে নাব্যতা সঙ্কট সৃষ্টি করছে।
জানতে চাইলে গাংনী উপজেলার কেশবনগর গ্রামের কোমর বাঁধের মালিক আনারুল ইসলাম বলেন, সরকারি নদী পড়ে থাকে তাই বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার করছি। এতে নদীর ক্ষতি হচ্ছে কিনা তা আমি বলতে পারবো না।
সদর উপজেলার আলমপুর গ্রামের অনেকেই কাজলা নদী দখল করে ধান আবাদ করছে। এদের একজন হচ্ছেন আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, নদীর পাড়ে যাদের জায়গা জমি রয়েছে তারা নিজ নিজ সীমানার নিচে নদীর অংশ দখল করেছে। নিজের জমির মতো করেই ব্যবহার করছে। একজনের দেখাদেখি আরেকজন ব্যবহার করছে। প্রশাসনের কোনো বাধা না থাকায় দখলদাররা বেপরোয়া বলেও জানান তিনি।
এলাকাসূত্রে জানা গেছে, এক সময়ের খর¯্রােত কাজলা নদীও আজ মৃতপ্রায়। গাংনী উপজেলার ভোমরদহ গ্রাম থেকে সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রাম পর্যন্ত নদীতে এখন শুধুই ধান চাষ হচ্ছে। নদীর দু’পাড় কেটে তলানিতে ফেলে সমতল করা হয়েছে। বোরো ধানের চারা উৎপাদনের জন্য মূলত নদী কাটা হয়। চারা তোলার পর ওই স্থানগুলোতে ধান চাষ করা হয়েছে।
অপরদিকে ছেউটিয়া নদীরও একই চিত্র। গাংনী উপজেলার বানিয়াপুকুর গ্রাম থেকে শুরু করে সদর উপজেলার কচুইখালী গ্রাম পর্যন্ত শুধুই ধান চাষ হচ্ছে। মাটি কেটে নদী সমতল সৃষ্টি করায় বর্ষা মরসুমে নদীর স্বাভাবিক গতিবিধি বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফলে নদীর উজানে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
গাংনী সরকারি ডিগ্রি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনারুল আযিম বলেন, জেলার চারটি নদীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। নদীর মাছ ও জলজপ্রাণি হুমকির মুখে। বর্ষা মরসুমে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের অভাব ও নদী শাসনের ফলে নাব্যতা সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। এতে নদীর গতিপথ পাল্টে যাবে নয় তো মৃতনদীতে পরিণত হবে। কৃষি প্রধান এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নদীগুলো দখলমুক্ত করে দ্রুত পুনর্খননের ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে জলবায়ু যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে একদিন মানুষের জীবনই বিপন্ন হতে পারে।
মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ বলেন, স্থানীয় ভূমি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খুব দ্রুত নদীর দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে নদী পুনর্খনন হলেই কেবল দখলমুক্ত করে রাখা সম্ভব। সেলক্ষ্যে সরকারের ঊর্দ্ধতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।