ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরবে কি?

২০১৭ সালকে ব্যাংক লুটপাটের বছর হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহল। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, চুরি, ঋণ জালিয়াতির ঘটনা গত বছর ঘটলেও বিচারের কাঠগড়ায় কোনো অপরাধীকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি, এমনকি নেয়া হয়নি জবাবদিহিতার মুখে দাঁড় করানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও।

চলতি বছর যেখানে সবার প্রত্যাশা ছিলো অর্থ লোপাটকারীদের বিচারের আওতায় এনে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর উদ্যোগ নেবে সরকার, সেখানে জনগণের অর্থের ভাণ্ডার ব্যাংকগুলোর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ায় এক অর্থে লোপাটকারীদের পুরস্কৃত করা হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

দুর্নীতি, জালিয়াতি ও চুরির মাধ্যমে মূলধন পর্যন্ত খেয়ে ফেলা সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য এ বছর যেসব সুবিধা দেয়া হয়েছে, তা থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট। প্রথমে সরকারি ব্যাংকগুলো তাদের তারল্য সংকট কাটানোর জন্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি চেয়েছে। এর মধ্যে পুরোটা না পেলেও মোটাঅঙ্কের ভর্তুকি যে তারা পাবে, তা অতীতের রেকর্ড এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের ইতিবাচক মনোভাব থেকে বোঝা যায়। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিরাপত্তার জন্য জনগণের আমানতের যে সাড়ে ছয় শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা (সিআরআর) রাখত, তা এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ করে এরই মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ টাকা ছাড়ের সার্কুলার মঙ্গলবার জারি করেছে। পাশাপাশি সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এ খাতের মালিকরা ১ লাখ কোটি টাকা সংগ্রহে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। সরকারের এ দুটি সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট কমাবে নাকি নির্বাচনের বছর অসাধু ব্যাংক মালিক-নির্বাহীদের অনিয়ম ও লুটপাটে আরও উৎসাহী করে তুলবে, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি।

মূলধন খেয়ে ফেলা বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যানই ঋণ দেয়ার নামে ১৪০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ওই অর্থে স্ত্রী-সন্তানদের নামে গড়ে তুলেছেন শিল্পকারখানা; কিন্তু কোনো সাজার মুখে তাকে পড়তে হয়নি এখনও। সরকারি বেসিক ব্যাংককে পঙ্গু করে দেয়া প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিজেদের মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ একক ব্যক্তিকে ঋণ দিয়ে ধুঁকতে থাকা জনতা ব্যাংকের লোপাটকারীরাও আছেন বহাল তবিয়তে। এ অবস্থায় সিআরআর থেকে এক শতাংশ এবং সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংককে দেয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। আশার কথা, শেষ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের দাবি মেনে ঋণখেলাপি ও দুর্নীতি রোধে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জিডিপিতে ব্যাংকিং খাতের অবদান ১৯.৭৫ শতাংশ, এটি আরও বাড়ানো এবং সুশাসনের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যদি কমিশনকে যথেষ্ট শক্তিশালী ও স্বাধীন করা যায় তবে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে, অন্যথায় নয়।