মেধাবীদের বঞ্চিত করার ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হোক

সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে শাহবাগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলা চালিয়েছে। গত রোববার সন্ধ্যার পর আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া আর সংঘর্ষে শাহবাগ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিপেটায় কয়েকজন আন্দোলনকারী ও পথচারী রক্তাক্ত-আহত হন। গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সাথে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এ হামলায় অংশ নেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ একটি আন্দোলনে পুলিশি হামলার ঘটনা নজিরবিহীন উল্লেখ করেছেন বিশিষ্টজনরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এ ঘটনার তীব্র নিন্দাও জানানো হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন মৌলিক অধিকার, সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর ন্যাক্কারজনক পুলিশি হামলা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

তথ্য মতে, বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা আন্দোলন করছেন। তাদের দাবি বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। অস্বীকার করা যাবে না যে, কোটা পদ্ধতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মেধাবী সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের ওপর। কোটার ভিত্তিতে প্রশাসনসহ নানাস্তরে অযোগ্যরা নিয়োগ পাচ্ছেন, পক্ষান্তরে মেধাবীরা হচ্ছেন বঞ্চিত। বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ৫৫ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের অগ্রাধিকার কোটা আছে। আর বাকি ৪৫ শতাংশ নিয়োগ হয় মেধা কোটায়। আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে এই হামলা অত্যন্ত পরিতাপ এবং উদ্বেগের। এমন দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্টদের একদেশদর্শিতাপূর্ণ মনোভাবও স্পষ্ট হয়, যা কারো প্রত্যাশা নয়।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি চালুর নেপথ্যে যুক্তি অবশ্যই আছে। অনগ্রসর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের চাকরির ক্ষেত্রে ঠাঁই দিতে এই পদ্ধতি গৃহিত হয়। এতে মেধার প্রাধান্য হয়তো ততোটা থাকতো না, যুক্তি ছিলো, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র বঞ্চিত করতে পারে না। আবার সংবিধানের ১৯ (১) ধারায় উল্লেখ আছে, রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্রের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে। কিন্তু সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কিংবা নারীর জন্য রাষ্ট্রের যে একটা দায়-দায়িত্ব রয়েছে, তা পালনেই কোটা প্রথার চালু। বর্তমানে সরকারি চাকরির ৫৫ শতাংশ কোটার মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ শতাংশ, নারীর ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য নির্ধারিত। এখন সময় পাল্টেছে, রাষ্ট্রের সব জাতিগোষ্ঠীই আগের তুলনায় অধিক শিক্ষিত। তাদের মধ্যে মেধাবীর সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। নারী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য কোটা প্রথাও স্বাভাবিক। কিন্তু সবক্ষেত্রে কোটা রক্ষা কতোটা যৌক্তিক, তাও সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা সমীচীন। আর আন্দোলনকারীরা কোটা প্রথার বিপক্ষে নন, তারা প্রচলিত কোটার সংস্কার চান, ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি তুলেছেন। সঙ্গত কারণে এটি সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় নেয়া যৌক্তিক এবং আলোচনার মাধ্যমেও এর সুরাহা হতে পারে বলেই আমরা বিবেচনা করি।

জানা যায়, ২০১০ সালের এক দাফতরিক আদেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেসব পদ খালি রাখার নির্দেশনা দেয়ার পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর, দফতরসহ সরকারি কর্মকমিশন শূন্যপদে নিয়োগ দিতে পারেনি। উপজেলা আনসার ও ভিডিপির সার্কেল অ্যাডজুট্যান্টসহ নয় হাজার স্টাফ নার্স নিয়োগের ক্ষেত্রেও সমস্যাক্রান্ত হয় পিএসসি। শূন্য থেকে যায় কারিগরি ক্যাডারের অনেক পদ। এসব বিবেচনায় কেউ কেউ মনে করেন সমাজের কোনো অংশকে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে বৃহত্তর অংশকে বঞ্চিত করা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। এর সুষ্ঠু সমাধান অপরিহার্য।

পদ্ধতিগত কারণে যোগ্য ও মেধাবী অনেকেই নিয়োগ বঞ্চিত হন, যা অস্বীকার করা যায় না। আবার পদ খালি থাকায় সরকার ও রাষ্ট্র মেধাবী এবং যোগ্যদের সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়। এসব বাস্তবতার আলোকে চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে হতাশা-ক্ষোভও স্বাভাবিক। প্রশাসনকে দক্ষ ও গতিশীল করার ক্ষেত্রে মেধার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। ফলে মেধাবীদের বঞ্চিত করার ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হোক।