লাঠিপেটা : পদদলনে ঝরলো ২৭ জনের প্রাণ

ময়মনসিংহে নূরানী জর্দ্দা ফ্যাক্টরিতে জাকাত নিতে উপচেপড়া ভিড়

 

moymonshing-_291987

স্টাফ রিপোর্টার: ভোরের ঠিক আগে অপরিসর গলিতে হাজার খানেক নারী-পুরুষের ভিড়, তিন ফুট প্রশস্ত ফটক দিয়ে আগে ঢোকার মরিয়া চেষ্টা, ভিড় সামলাতে লাঠিপেটা, হুড়োহুড়ি এবং মারামারি- এ ছিলো ময়মনসিংহে পদদলনে মৃত্যুর দৃশ্যপট।

ময়মনসিংহ পৌরসভার কাছে নূরানী জর্দ্দা ফ্যাক্টরিতে জাকাতের কাপড় নিতে এসে পদদলিত হয়ে কমপক্ষে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ভোরের এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো অর্ধ শতাধিক। ঘটনা তদন্তে পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশ সুপার মঈনুল হক মৃতের সংখ্যা ২৭ জন বলে নিশ্চিত করেছেন। তবে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি। নূরানী জর্দ্দা কারখানার মালিক ও তার ছেলেসহ আটজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। বিকেলে পুলিশ বাদী হয়ে কোতয়ালি মডেল থানায় এ মামলা করেন। এর আগে সকালেই কারখানার মালিকসহ আটজনকে আটক করা হয়, জারা মামলার পর গ্রেফতারের আওতায় এসেছে। এদিকে হতাহতের কারণ খতিয়ে দেখতে পুলিশ ও জেলা প্রশাসন দুটি তদন্ত কমিটি করেছে। পুলিশ প্রশাসন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে প্রধান করে এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মল্লিকা খাতুনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, কারখানা মালিক শামীম, শামীমের ছেলে হেদায়েত হোসেন তালুকদার, কারখানার ম্যানেজার ইকবাল হোসেন, শামীমের আত্মীয় আরমান হোসেন, আলমগীর হোসেন, কারখানার কর্মচারী শামসুল ইসলাম আবদুল হমিদ ও গাড়ি চালক পারভেজ।

জেলা প্রশাসক মুত্তাকিম বিল্লাহ ফারুকি জানান, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসন ১০ হাজার ও ধর্ম মন্ত্রণালয় ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেবে। আহতদের মধ্যে ৪ জনকে গুরুত্বর অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ২৫ জনেরই নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। নিহতরা হলো- শহরের পাটগুদাম বিহারী ক্যাম্পের সিরাজুলের ছেলে সিদ্দিক (১২), নুরু ইসলামের স্ত্রী সখিনা (৪০) ও তার মেয়ে লামিয়া (০৫), মৃত বারেকের স্ত্রী সামু বেগম (৬০), মৃত জুম রাতির স্ত্রী হাজেরা খাতুন (৭০), মৃত্যুঞ্জয় স্কুল রোডের বসাক পট্টির গোবিন্দ বসাকের স্ত্রী মেঘলা বসাক (৫৫), শহরের ধোপাখোলা এলাকার নারায়ণ চন্দ্র সরকারের স্ত্রী সুধা রাণী সরকার (৫৫), মৃত বজেন্দ্র’র স্ত্রী রিনা (৬০), মৃত সুলতান মিয়ার স্ত্রী জামেনা বেওয়া (৬৫), চরপাড়া এলাকার হায়দার আলীর স্ত্রী হামিদা বেগম (৪৫), আকুয়া দক্ষিণ পাড়ার জালালের স্ত্রী নাজমা বেগম (৫০), ফজলু মিয়ার স্ত্রী মোমতাজ বেগম (৪০), সালামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৫৫), আকুয়া দরগাপাড়ার রাজা মিয়ার স্ত্রী নাজমা আক্তার (৬০), রবি হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৫২), কাঠগোলা বাজারের আব্দুল মজিদের স্ত্রী রেজিয়া আক্তার (৫৫), কাঠগোলা ডোলাদিয়ার রতন মিয়ার কন্যা রুবি অক্তার (১২), কাঁচারীঘাট এলাকার মাহাতাব উদ্দিনের স্ত্রী ফজিলাতুন নেসাম (৭৫), থানাঘাট এলাকার আব্দুস সালেকের স্ত্রী খোদেজা বেগম (৫০), চর ঈশ্বরদিয়ার লালু মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন (৬০), তারাকান্দা থানার বালিডাঙ্গা গ্রামের মোসলেম মিয়ার স্ত্রী মরিয়ম (৫০), কালিবাড়ি এলাকার শফিকুল ইসলামের স্ত্রী আঙ্গুরী বেগম (৩৫). ত্রিশালের বালিপাড়া গ্রামের আঞ্জু মিয়ার স্ত্রী সাহরন বেগম (৪০) ও জামালপুর জেলার হরিণাকান্দা গ্রামের আবুল হোসেনের কন্যা ইতি বেগম (১২)।

প্রতি বছরের মতো এবারও ময়মনসিংহ শহরের অমৃত বাবু রোড এলাকার বাসিন্দা নূরানী জর্দ্দা ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারী শামীম তালুকদার জাকাত দেয়ার ঘোষণা দেন। শহরের বিহারী ক্যাম্প, দুলদুল ক্যাম্প ও থানাঘাট বস্তিসহ শহরের বস্তি এলাকায় হতদরিদ্রদের মাঝে ৬শ কার্ড বিতরণ মাধ্যমে শুক্রবার সকাল থেকে জাকাতের ওই শাড়ি-লুঙ্গি প্রদানের দিন ধার্য করে। সে লক্ষ্যে সেহরির পর থেকে আনুমানিক দু থেকে তিন হাজার লোক অপেক্ষা করতে থাকে ওই বাড়ির সামনেসহ আশপাশের অলিগলিতে।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয়রা বলেছ্নে, ভোর পৌঁনে ৫টার দিকে জাকাতের জন্য গেটের ভেতর প্রবেশ করতে চাইলে ফ্যাক্টরির কর্মচারীরা বাঁধা দেয় এবং ভেতর থেকে লাঠিপেটা করে। এ সময় হুড়োহুড়ি করে ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে ঘটনাস্থলেই ৮ থেকে ১০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় অর্ধ শতাধিক। পরে স্থানীয়রা তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে মারা জায় আরো ১০/১২ জন।

ঘটনার পরপর জেলা প্রশাসক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী ও পুলিশ সুপার খন্দকার মঈনুল হক ২৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বলেন, এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। নিহতদের মধ্যে ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হাসপাতাল মর্গ থেকে পুলিশ দুজনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন। নিহতদের মধ্যে ২০ মহিলা ও তিন শিশু রয়েছে। মহিলাদের বেশিরভাগই বয়োবৃদ্ধ।

ঘটনার পর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন ঘটনাস্থল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। একসাথে এতো মৃত্যুর খবর শুনে শোক ও সমবেদনা জানান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। তিনি নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে প্রদানের ঘোষণা দেন। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেক পরিবারের সদস্যদের ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করেন।

নূরানী জর্দ্দা ফ্যাক্টরির কর্মচারীদের লাঠিপেটার কারণেই এতগুলো হতদরিদ্রের প্রাণ গেছে বলে অভিযোগ করেছেন জাকাত নিতে আসা অনেকেই। তাদের অভিযোগ শামীম তালুকদার ৬শ জনকে কাপড় দেবেন অথচ চরাঞ্চল থেকে শুরু করে সারা শহরেই প্রচার চালান। জা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। তাদের অভিযোগ, অতিরিক্ত ভিড় এড়াতে ভোর রাতে প্রধান ফটকে ফ্যাক্টরির কর্মচারীরা লাঠিপেটা করে তাদের সরিয়ে দেয়োর চেষ্টা করে। তারা জানায়, শাড়ি দেবে ৬শ জনকে। অথচ শুধু পাটগুদাম বিহারী ক্যাম্পেই কার্ড বিতরণ করেছে চারশ’র মতো। এছাড়া আকুয়া, মড়লপাড়া, দরগাপাড়া, শিকবার, থানাঘাট বস্তিসহ বিভিন্ন বস্তিতে জাকাত দেয়ার কথা বলে খবর পাঠানো হয়। ফলে তিন থেকে চার হাজার লোক সমাগম হয় সেহরির পরপরই। ভোরে ওই বাড়ির সামনে জাকাত নিতে আসা ও অবস্থানরত হতদরিদ্র জমিলা খাতুন, রইসা, পারুল বেগম ও রেবেকা বেগমসহ স্থানীয়দের অভিযোগ, ভিড় এড়াতে তাদের নির্দয়ভাবে লাঠিপেটা করা হয়েছে। ফলে বয়োবৃদ্ধরা দিগবিদিক ছুটোছুটি করতে গিয়ে পায়ের নীচে চাপা পড়ে মারা গেছে। তারা আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে জানায়, জুতার মিছিল দেখলেই বুঝতে পারবেন অসহায় মানুষগুলো কিভাবে মারা গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই বাড়ির সামনে কোথাও রক্তের থোপ অথবা কোনো লাশের গাঁয়ে কাটা-ছেঁড়ার কোনো চিহ্ন নেই। এ যেন শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু সবার। আর এতো মানুষের লাশ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে নির্বাক স্থানীয় বাসিন্দারাও। তারা জানায়, মৃতের সংখ্যা ২৭ থেকে ৩০ জন হবে। আশপাশের অলিগলি থেকেও কয়েকটি লাশ রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখেছেন তারা। এলাকাবাসী আরো জানায়, মাত্র ৬শ শাড়ি দেবে নূরানী জর্দ্দা ফ্যাক্টরির মালিক। অথচ সারা শহরে প্রচার চালানো হয়েছে। এমনকি পুলিশ প্রশাসনকেও জানানো হয়নি। এব্যাপারে ফ্যাক্টরির মালিক শামীম তালুকদার বলেন, আমরা ৬শর মতো জাকাতের শাড়ি বিতরণের জন্য কার্ড দিয়েছি। বাকি শুনে এসেছেন। কিন্তু এতো লোক সমাগম হবে তা ভাবতে পারিনি। আর আমাদের কর্মচারীরা কাউকে পিটায়নি। প্রধান ফটকে জটলা কমাতে এরা জাকাত নিতে আসাদের দূরে থাকতে বলেন। পুলিশ সুপার মঈনুল হক জানান, জাকাতে এতো লোক সমাগম হবে অথচ পুলিশ প্রশাসনকে জানানো হয়নি। এটা ঠিক হয়নি তাদের। এদিকে নিহতদের পরিবারে চলছে এখন শোকের মাতম। কেউ মা, কেউ স্ত্রী অথবা সন্তানকে হারিয়ে নির্বাক স্বজনরা। প্রতিটি বাড়িতে চলছে স্বজন হারোনোদের আহাজারি। ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে নিহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এক শোকবার্তায় আহতদের চিকিত্সা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। ময়মনসিংহ শহরের অতুল চক্রবর্তী রোডে নূরানী জর্দা কারখানায় জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে অন্তত ২৬ নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শুক্রবার এক শোকবার্তায় তিনি এ মর্মান্তিক ঘটনায় জারা মারা গেছেন তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং মৃতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও শোক প্রকাশ করে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামানা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।