সম্পাদকীয়

 

ভাড়া বাড়িয়ে রেলের লোকসান কমানো সম্ভব নয়

আজ থেকে রাষ্ট্রীয় পরিবহনসেবা খাত রেলের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায় কিলোমিটারপ্রতি ৩৯ পয়সা হারে ভাড়া নির্ধারণ করা হচ্ছে যার শতকরা বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১২ সালে রেলের ভাড়া বাড়ানো হয়েছিলো ৫০ শতাংশ। অভিযোগ রয়েছে, ভাড়া বাড়ানো হলেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে দিন দিন রেলের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন উভয়ই কমছে। অন্যদিকে বিনা ভাড়ায় ভ্রমণকারীর সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে। এসব দিক বিবেচনায় রেলওয়ের উন্নয়নে ভাড়া বাড়ানো হলেও যাত্রীসাধারণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলের বেহাল দশা নিয়ে এ যাবত অনেক খবরই প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। আলোচনা-সমালোচনাও কম হয়নি। ফলে রেলের মতো একটি সরকারি সেবামূলক খাতে একবারে ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সাড়ে তিন বছরের মাথায় আবারো ভাড়া বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয়।

২০১২ সালে ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সময় তুলে দেয়া হয়েছিলো ভর্তুকি। ফলে টিকেটের দাম শ্রেণিভেদে ৭০ থেকে ১১০ শতাংশ বেড়েছিলো। তখন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলো, লোকসান কমানোর পাশাপাশি যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধি তাদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এ সাড়ে ৩ বছরে রেলের বাস্তব সেবা যে কী তা ভুক্তভোগীমাত্রই ওয়াকিবহাল। এবারো একই কারণ দেখিয়ে রেলের ভাড়া আরেক দফা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, যা আজ রোববার থেকেই কার্যকর হতে চলেছে। এবারো যুক্তি দেখানো হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম এবং রেলের সংশ্লিষ্ট খরচ বৃদ্ধির। অন্যদিকে এ সাড়ে ৩ বছরে রেলের লোকসান কতটুকু কমেছে সে চিত্রও কর্তৃপক্ষ দাখিলে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো রেলে যাত্রীসেবার মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কাজেই আরেক দফা ভাড়া বাড়ালেই যে সেবার মান বাড়বে, এমন আশ্বাস-নিশ্চয়তা কে দেবে।

ভাড়া বাড়িয়ে রেলের লোকসান কমানো সম্ভব নয়। এছাড়া এ খাতে দুর্নীতির বিষয়টিও বহুল উচ্চারিত। ফলে লোকসান কমানোর অজুহাতে ভাড়া বাড়িয়ে যাত্রীদের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে রেলের ভূমির বাণিজ্যিক ব্যবহার বৃদ্ধি, ইজারামূল্য বৃদ্ধি, ট্রেনে উন্নতমানের বগি সংযোজন এবং বিনা টিকেটে ভ্রমণ রোধ করার মতো পদক্ষেপ নেয়া হলে রেল কর্তৃপক্ষের আয় বাড়তে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে পণ্য পরিবহনের দিকেও নজর দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি করা গেলে বড় অঙ্কের রাজস্বও বাড়তো বলে মনে করেন তারা। অথচ সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা স্বল্প আয়ের যাত্রীদের ওপর দৃশ্যমান চাপ বাড়াবে। এতে বিনা ভাড়ায় ভ্রমণের প্রবণতাও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘকাল অবহেলায় থাকা রেলের কার্যক্রমে গতি এসেছে বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে। রেলকে গুরুত্ব দিয়ে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় করা হয়েছে। রেলের সম্প্রসারণে নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার বেশ কিছু বাস্তবায়নাধীন। রেলের উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতায় আস্থা রেখেই সাড়ে তিন বছর আগে ৫০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধিও যাত্রীরা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার মানের উন্নয়ন না ঘটায় সবাই হতাশ। এ অবস্থায় আবারো ভাড়া বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। রেল জনগণের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় সেবামাধ্যম। ফলে এ খাতের সামান্যতম ভাড়া বৃদ্ধিতে সরাসরি ভুক্তভোগী হন দরিদ্র মানুষ। রেলওয়েকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পাশাপাশি গণযোগাযোগ নিশ্চিতকরণে সরকারের দায়বদ্ধতার বিষয়টিও খেয়াল রাখা জরুরি। রেলের উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। এর জন্য অর্থও দরকার। রেল খাতের উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তবে ভাড়া বাড়ানোয় যাত্রীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে, যা সরকারের জনপ্রিয়তার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে আমাদের এমন আশঙ্কারও যৌক্তিকতা রয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনায় নেয়া সমীচীন। রেলে যাত্রীসেবার মান উন্নয়ন হোক।