সর্বত্র বদলানোর বাতাস রুখতে তৎপর গাংনীর চেংগাড়া

মাজেদুল হক মানিক: আধুনিক উৎকর্ষতার যুগে গ্রামীণ খেলাধুলা আজ বিলুপ্তির পথে। হারিয়ে যাওয়া বিনোদনের মাধ্যমগুলো আজ ইতিহাস হতে চলেছে। হারানোটা কালের বিবর্তনের ধারা বোধ হয়। প্রবীণদের অনেকে এরকমই মন্তব্য করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছেন, হারানো ওইসব খেলাধুলার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেতো বিনোদন। এখন? সব কিছুতেই যেন বদলানোর বাতাস। মনোমুগদ্ধকর পরিবেশ হারানোর হিড়িক।
এগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলেও দেশের অগণিত মানুষ আজও এ খেলাগুলো লালন করেন। বিদ্যালয়গুলো অবশ্য বছরান্তে রুটিন মাফিক আয়োজনে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলার কিছু অংশ ধরে রেখেছে। এ ছাড়া প্রজন্মের কাছে বিনোদন বলতে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটারেই বন্দি হয়ে পড়েছে। অবশ্য গ্রামীন বিনোদন বলতে কিছু খেলা ধরে রাখতে এবারো মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার চেংগাড়া গ্রামে আয়োজন করা হয় গ্রাম্য খেলার প্রতিযোগিতা। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এলাকার কয়েক হাজার দর্শক মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন এ প্রতিযোগিতা।
ষাটোর্ধ্ব বয়েসের পুরুষরা ব্যস্ত হাড়িভাঙায়, ছোট্ট শিশুরা মোরগ লড়াইয়ে, তরুণরা সাইক্লিংয়ে আর মেয়েরা ব্যস্ত চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতায়। শুধু উৎপাদন নয়, টমেটো খাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কৃষকরা প্রমাণ দিলেন তারাও পিছিয়ে নেই। তবে সবশেষে অনুষ্ঠেয় তৈলাক্ত কলাগাছে ওঠার প্রতিযোগিতার দিকেই উপস্থিত দর্শকদের নজর ছিলো বেশি।
সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন গাংনী পৌর মেয়র আশরাফুল ইসলাম। তিনি তার বক্তব্যে এ ধরনের ব্যতিক্রমী আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অপসাংস্কৃতিক রুখতে এ ধরনের খেলা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। এক সময় হরহামেশাই এমন দৃশ্যের দেখা মিলতো গ্রামগঞ্জ ও পাড়া মহল্লায়। এক অনাবিল আনন্দ উল্লাসে জনজীবন হয়ে উঠতো প্রাণবন্ত। উৎসুক দর্শনাথীদের কলরবে ভরে উঠতো মাঠ। কিন্তু কালের বিবর্তন আর অপসাংস্কৃতির আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ এসব খেলাধুলা। তরুণ প্রজন্মের কাছে এসব যেন এখন শুধুই ইতিহাস। ঐতিহ্যবাহী এসব খেলাগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে গত ২ বছরের ন্যায় এবারো চেংগাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে খেলাধুলা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ওই গ্রামের কয়েক যুবক।
দিনভর এসব আয়োজনে বয়স্করা অনেকদিন পর খেলায় অংশ নিয়ে উচ্ছ্বসিত। শুধু খেলাধুলাই নয়, আয়োজন করা হয়েছিলো যেমন খুশি তেমন সাজো। ছোট্ট শিশুরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে নিজের দেহে কাদা-মাটি লাগিয়ে হাতে প্রতীকী অস্ত্র হাতে সারামাঠ ঘুরে প্রতিযোগিতায় এনে দেয় এক অন্যরকম অনুভূতি। জীবন্ত ৩ শিশু অপরাজেয় বাংলার ভাষ্কর্য সেজে দেখালো তারাও শিখছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। হাজার হাজার দর্শক মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করে এ প্রতিযোগিতা। প্রতিবছর এ ধরনের আয়োজনের দাবি জানান তারা।
বিনোদনের অভাবে যুবসমাজ আজ বিপথগামী। অনেকেই বিপথে গিয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। অথচ গ্রামীণ এ খেলাধুলাগুলো একে অপরের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয়। এ ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা করতে পারলে তরুণরাও বিপথ থেকে ফিরে আসবে বলে মনে করেন ফতাইপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন।
বিলুপ্ত এ খেলাগুলো পুনরুজ্জীবিত ও তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এ ধরনের আয়োজন। দর্শক ও খেলোয়াড়দের সাড়া পেয়ে প্রতি বছর এ ধরনের আয়োজন করা হবে বলে জানালেন আয়োজক কমিটির সভাপতি ইউসুফ আলী।