দাবদাহ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা

তীব্র তাপপ্রবাহসহ নানা কারণে বাংলাদেশে সাধারণত মধ্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডায়রিয়া পরিস্থিতি বিরাজমান থাকে। এ সময়ে ডায়রিয়া, পেটের পীড়া, আমাশা, টাইফয়েড, জন্ডিসসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণের পাশাপাশি ওয়াসার অত্যল্প পানি সরবরাহ, বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট, প্রচণ্ড গরমে রাস্তার পাশে বিক্রি করা ধুলাবালি মিশ্রিত বরফ, তরমুজ, আনারস এবং কাঁচা আম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফলের শরবত পান করার কারণেই এ সময়ে ডায়রিয়াসহ নানা গরমজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। তীব্র গরমের সময় বাড়ে বিদ্যুতের অসহনীয় লোডশেডিংও। লোডশেডিংয়ে কষ্ট ধনীদের স্পর্শ করতে না পারলেও দরিদ্র্যজনদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দেয়। তীব্র গরমে দরিদ্র্যপল্লীর জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। দেখা দেয় তীব্র পানিসঙ্কটও। বিদ্যুত সঙ্কটের কারণে ওয়াসার পাম্প মেশিনগুলো হয়ে পড়ে প্রায় অকার্যকর। ফলে ওয়াসা নগরবাসীর জন্যে প্রয়োজনীয় পানির সরবারহ নিশ্চিত করতে পারে না। আবার পাইপ লাইনগুলোতে পানিপ্রবাহ কম হওয়ার কারণে সরবরাহকৃত পানিতে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ থাকে বেশি। তাছাড়া ওয়াসার পাইপ লাইনগুলোর প্রয়োজীনয় সংস্কার না হওয়ায় কোনো কোনো স্থানে পানি ও স্যুয়ারেজ লাইন একাকার হয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে। এতে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি মিশে যাচ্ছে ওয়াসার পানিতে। আর এসব পানি ব্যবহার ও পান করে নাগরিকসাধারণ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগ-ব্যাধিতে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগুলোর সুদৃষ্টি নেই।

মার্চ থেকে গরম শুরু হলেও এপ্রিল মাসের প্রথম থেকে ডায়রিয়া, পেটের পীড়া, আমাশা, টাইফয়েড, জন্ডিসসহ নানা রোগ বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী ভর্তির খবর আসছে। তীব্র তাপদাহের কারণে গরমজনিত নানা রোগ হানা দিচ্ছে জনজীবনে। উল্লেখ্য, ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রিকে মৃদু, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিকে মাঝারি ও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখন মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আর প্রচণ্ড তাপদাহের সময় রোটা ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি ঘটে। ভাইরাসটি সাধারণত ধূলাবালিযুক্ত খোলা খাবার বিশেষ করে শহর-গ্রামে রাস্তার পাশে বিক্রি করা খোলা খাবার, মশলাদার ও বাসি খাবার এবং দূষিত পানির মাধ্যমে খুব সহজে ঢুকে পড়ে মানবদেহে। আর এই ভাইরাসটিই হচ্ছে ডায়রিয়ার মূল কারণ। সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা গেলে ডায়রিয়ার মতো রোগব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। বাংলাদেশের মানুষ এ বিষয়ে অসচেতন বলেই ডায়রিয়াসহ নানা রোগ-ব্যাধির সংক্রমণ বাড়ছে। আর ডায়রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা।

বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ডায়রিয়ায় প্রতি বছর যারা নিহত হয় তাদের বেশির ভাগই হচ্ছে শিশু। পানি ও লবণ-শূন্যতার কারণ শিশুদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষ সচেতন হলে এবং শিশুদের প্রতি যত্নশীল হলে শিশুরা ডায়রিয়া থেকে অনেকটা নিরাপদ থাকবে।

প্রসঙ্গত, ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে টক্সিন, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য ক্ষতিকর বন্তু বের হয়ে যায়। আর এসব বস্তু বের হয়ে যাওয়ার সময় অন্ত্রের সাময়িক বিপর্যয় ঘটায়। একই সাথে এসব বস্তু বের হয়ে যাওয়ার সময় প্রচুর পানি ইলেকট্রোলাইট তথা সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ লবণও বের হয়ে যায়। আবার বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়ার পাশাপাশি চুলকানি, জন্ডিস ও খোস-পাঁচড়াসহ নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়। এতে যে ইনফেকশন তৈরি হয় তাতে পরবর্তী পর্যায়ে কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। চরম উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডায়রিয়ার পাশাপাশি নানা ধরনের চর্মরোগেরও শিকার হয়। বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট ও গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া চর্মরোগীদের প্রায় ৯৫ ভাগেই হয় শিশু।

তীব্র তাপপ্রবাহের এ সময়ে ডায়রিয়া ও চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসা ও ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি যেসব কারণে রোটা ভাইরাস ছড়ায় সে সব বিষয়ে সৃষ্টি করতে হবে জনসচেতনতা। নিশ্চিত করতে হবে বিশুদ্ধ পানি ও ভেজালমুক্ত খাবারও। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, ওয়াসার জন্যে পর্যাপ্ত বিদ্যুত সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা ও ওয়াসার কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাড়িঘরের পানির ট্যাংক পরিষ্কার রাখা ও পানি ফুটিয়ে খাওয়ার ব্যাপারেও সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একই সাথে ওরস্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মুনাফা শিকারে লিপ্তদের বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। প্রচণ্ড গরমে সাধারণ মানুষ রাস্তার পাশে বিক্রি করা ধুলাবালি মিশ্রিত বরফের শরবত, তরমুজ, আনারস, কাঁচা আমসহ বিভিন্ন ধরনের ফলের শরবত পান করে থাকে। এসব খাবারে ধুলাবালি ছাড়াও অন্যান্য মারাত্মক জীবাণুও থাকে। ফলে এই সব খাবার খেয়ে অনেকে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়। এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।

ডায়রিয়ার মূল কারণ ও নিরাপদ থাকার উপায় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার যুৎসই কর্মসূচি থাকলে এবং সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যমসহ দেশের সব সংস্থা ও ব্যক্তি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে কাক্সিক্ষ ফল পাওয়া যাবে। আবার প্রখর দাবদাহে হিটস্ট্রোকের আশঙ্কাও থাকে প্রবল। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিটস্ট্রোকে বেশ কয়েকজন আক্রান্ত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অনেক লোক মারা গেছেন। তাই হিটস্ট্রোক থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। প্রখর রোদে ছাতা ব্যবহার, প্রচুর পরিমাণ পানি পান করা, তেঁতুল, আনারস, কাঁচা আম, পাতিলেবু, তরমুজ ও বেলের শরবত পান করলে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি থাকা দরকার।