মাছে-ভাতে বাঙালি আবার

 

গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের উপকথাতুল্য কাল্পনিক ছবি বাঙালির মানসপটে আঁকা আছে চিরন্তন; তবে তা বাস্তবে কতটুকু ছিলো সে গবেষণার বিষয়। থাকলেও চাষি-মজুর যে তার স্বাদ পায়নি এটা নিশ্চিত। তবে প্রকৃতির অফুরন্ত দানে ভরা এই দেশে গরিব মানুষ কাঁচা লংকাযোগে দুটি পান্তা ভাত আর খালে-বিলে পলো-হাতজাল ফেললেই নিমেষে নিখরচায় খালুই ভরে পাওয়া কৈ-পুঁটি-পাবদায় বেঁচে আছে বহু যুগ ধরে। ভাতের বেলায় আমাদের অভাব ঘুচেছে অনেকখানি উচ্চফলনশীল ও আয়-রোজগার বৃদ্ধির গুণে। মাছের এ চিত্রটি চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে পর্যন্ত যেমন ছিলো তা আর নেই। মাঝে হারিয়ে গেছে ক্রমাগত জনসংখ্যা বাড়ার সাথে জলাভূমি ভরাট ও দখল হওয়ায় এবং নদী-নালায় বিকট দূষণের ফলে। মৎস্যসম্পদ ভয়াবহভাবে কমে যাচ্ছিলো। এতে পুষ্টি নিরাপত্তায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়ার বিপদ সমীপবর্তী হয়। তবে দিন ঘুরছে। উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মাছে-ভাতে বাঙালির চিরন্তন স্বপ্ন ধূসর হয়ে গিয়েছিলো, আবার তা রঙিন হয়ে উঠবে। অবশ্য পরিবর্তিত রূপে। মিঠাপানির মাছ নদী-খাল-বিল-হাওর-বাঁওরের প্রাকৃতিক উৎসের বদলে পুকুরে চাষ করা অধিক প্রজননক্ষম জাতের রুই-তেলাপিয়া-পাঙাশ-কৈ প্রভৃতি মাছের মাধ্যমে। এর সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে সামুদ্রিক মাছের বিরাট ভাণ্ডার। এই খবরটি দেশবাসীকে স্বয়ং দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতি বছর উন্নয়ন-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দিবস ও সপ্তাহ পালন প্রায়শ গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়। কিন্তু এ বছর ১৯-২৫ জুলাই জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ আমাদের চমৎকার সুখবর দিচ্ছে। বুধবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত সপ্তাহের কর্মসূচি উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পাঁচ বছরের মধ্যে গভীর সমুদ্রে সম্পদ আহরণের উদ্যোগ নেবে সরকার। তিনি জানান, গভীর সমুদ্রে খনিজ ছাড়া মাছ ও বিভিন্ন খাদ্যসম্পদ রয়েছে। সেখানে মৎস্যসম্পদ জরিপের জন্য একটি জাহাজ কেনাসহ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।

উল্লেখ্য, বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নিয়ে ভারতের সাথে যে সমস্যা ছিলো তার ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটারই বাংলাদেশ পেয়েছে জাতিসংঘের সালিস আদালতের রায়ে ২০১৪ সালে। এই অর্জন ব্লু ইকোনমি তথা সামুদ্রিক সম্পদভিত্তিক অর্থনীতির বিরাট সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এ সম্পদ পাহারা দেয়া ও সদ্ব্যবহার করার আয়াসসাধ্য যোগ্যতাও আমাদের অর্জন করতে হবে। কিছুটা ধীরে হলেও বর্তমান সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে। সমুদ্রে মাছ ধরার শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ আমাদের রয়েছে, কিন্তু তা গভীর সমুদ্রে নয়। গভীরে সম্পদের পরিমাণ বহু গুণ বেশি। সামুদ্রিক মাছ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে এবং আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিণত হলে ভালো পুষ্টি জোগাবে। মিঠাপানির মাছের উৎপাদন বাড়াতে গত বছর যে মৎস্যচাষিরা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তাদের পুরস্কৃত করা হয়। এ কৃতিত্বগুলো ঘটেছে রুই, তেলাপিয়া ও কৈ মাছের পোনা উৎপাদন ও ইলিশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে।

গত ৭ জুলাই জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (ফাও) প্রকাশিত বিশ্বের মৎস্যসম্পদ সম্পর্কিত বার্ষিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ সুখবর পেয়েছি, বাংলাদেশে জনপ্রতি মাছ খাওয়া বাড়ছে। মিঠাপানির মাছের চাষ বাড়ায় এটা সম্ভব হয়েছে। এতে আমাদের কৃষি ও মৎস্যবিজ্ঞানীদেরও অবদান আছে। চার বছর আগে আমরা মাথাপিছু বছরে ১৪ কেজি মাছ খেতাম। চলতি বছর খাচ্ছি ১৯ কেজি। অর্থাৎ দ্রুতই বাড়ছে। শিল্পোন্নত দেশের মানুষ খায় বছরে ২৬ দশমিক ৮ কেজি। নদী-নালার দূষণ ঠেকানো, মিঠাপানির মাছের চাষ ও সামুদ্রিক মাছ আহরণ বাড়াতে পারলে বাঙালি মাছে-ভাতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারবে।