দর্শনাকে উপজেলা করণের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত

 

সমাবেশ ও যানবাহনে স্টিকার লাগানো শেষে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশ

হারুন রাজু/হানিফ মণ্ডল: দর্শনাকে উপজেলা করণের দাবিতে আন্দোলন এখন শুধু ফেসবুকে সীমাবদ্ধ নেই। এ আন্দোলন এখন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের। দলমত নির্বিশেষে সকলেই আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে স্বতস্ফূর্তভাবে। প্রাণের দাবি পূরণে যা যা করণীয় সবকিছুই করতে আটুট এলাকাবাসী। দাবি আদায় না করে আন্দোলনের মাঠ ছাড়তে নারাজ আন্দোলনকারীরা। যতোই দিন যাচ্ছে, ততোই যেন আন্দোলন বেগবান হচ্ছে। প্রতিটি কর্মসূচিতে সর্বস্থরের মানুষের অংশ গ্রহণই আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নিচ্ছে। দর্শনাবাসী তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আজ মাঠে নেমেছে। অধিকার আদায় না করে তারা ঘরে ফিরবেনা। পারকৃষ্ণপুর-মদনা, কুড়ুলগাছি, তিতুদহ, বেগমপুর, নবগঠিত নেহালপুর, গড়াইটুপি ইউনিয়ন ও দর্শনা পৌরসভার সমন্বয়ে দর্শনা উপজেলা বাস্তবায়নের আন্দোলনে চলছে লাগাদার কর্মসূচি। ধারাবাহিক এ আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে গতকাল শনিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দর্শনা বাসস্ট্যান্ড চত্বরে সমাবেশ ও যানবাহনে দর্শনাকে উপজেলা চাই লেখা সংবলিত স্টিকার লাগানো। এ দাবির প্রতি একত্মতা ঘোষণা করেছেন, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর, চুয়াডাঙ্গা জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদুল ইসলাম আজাদ, পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউপি চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম, দর্শনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোতালেব হোসেন, জহির রায়হান, রিকসা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হবা জোয়ার্দ্দার। দর্শনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকরামুল হক পিপুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশ বক্তব্য দেন ও স্টিকার লাগানো কাজে সহযোগিতা করেছেন কবি ও সাহিত্যিক আবু সুফিয়ান, হাবিবুর রহমান বুলেট, হারুন অর রশিদ, হুমায়ুন কবির, নজরুল ইসলাম মাস্টার, সাজ্জাদ হোসেন, মাহবুবুর রহমান মুকুল, ছাত্রনেতা আলআমিন, ব্রাইট, আ. লতিফ, নাসির উদ্দিন খেদু, দর্শনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হারুন রাজু, যুগ্মসম্পাদক আহসান হাবীব মামুন, সাবেক সভাপতি হানিফ মণ্ডল, আওয়াল হোসেন, সাংবাদিক কামরুজ্জামান যুদ্ধ, এসএম ওসমান, মিরাজ, রকি, রায়হান, তুহিন, শিমুল, রাকিব, মাসুদ, সাগর, আক্তার, তুর্জ, আদিত্ব, শোভন, আশা, ইসলাম, অন্তর, হৃদয়, মেহেদী, আমীন প্রমুখ। ২ দিন ব্যাপী কর্মসূচির ১ম দিনে আন্দোলনকারীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও আন্তরিকতার পরিচয় আন্দোলনকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। এ কর্মসূচিতে দর্শনা হল্টস্টেশনে যাত্রীবাহি বিভিন্ন ট্রেন, দর্শনা বাসস্ট্যান্ডের সব ধরণের যানবাহনে প্রায় ৭ হাজার স্টিকার লাগানো হয়েছে। আজ রোববার বিকেলে একই কর্মসূচি পালিত হবে দর্শনা পুরাতন বাজার দোয়েল চত্বরে। আজকের কর্মসূচিতে যথাসময়ে সকলকে উপস্থিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনের মুখপত্র আনোয়ার হোসেন। দুপুর দুটোর দিকে আন্দোলনকারীরা চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুসের হাতে উপজেলার দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছে। এ সময় জেলা প্রশাসকের কার্যলয়ে একমত পোষন করেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের প্রশাসক দামুড়হুদা উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মনজু। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রবেশদ্বার সীমান্ত শহর দর্শনা, চুয়াডাঙ্গা জেলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। দর্শনার রয়েছে বহু বছরের অতীত ইতিহাস, ঐহিত্য, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মুক্তিযুদ্ধে ঈর্ষান্বিত ভূমিকা। বৃটিশ শাসনামলে দর্শনা দিয়ে প্রবেশ করেছে দেশের প্রথম রেলপথ, স্থাপিত হয়েছে রেলওয়ে জংশন, দেশের বৃহত্তম শিল্প কারখানা কেরু অ্যান্ড কোম্পানী এবং কাস্টমস বিভাগ। বর্তমানে এই রেলপথে ঢাকা-কোলকাতা মৈত্রী ট্রেন চলাচল করছে, আমদানী-রফতানি বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। ভবিষ্যতে এশিয়ার দেশগুলির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার ও যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রবেশ দ্বার হিসেবে এই রেলপথটি আপনার সরকারের চুড়ান্তভাবে প্রস্তাব করেছে। কেবলমাত্র দর্শনার এই ৩টি প্রতিষ্ঠান হতেই সরকার প্রতিবছর ২শ কোটি টাকারও উর্ধ্বে রাজস্ব আদায় করে থাকে। অথচ দর্শনা কোনো প্রশাসনিক ইউনিট না হওয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন নানান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তেমনি সরকার কর্তৃক উন্নয়ন সুবিধা ও সেবা থেকে এই জনপদের মানুষ বিচ্ছিন্ন রয়েছে, বঞ্চিত হচ্ছে। দর্শনা থানা বাস্তবায়নের যৌক্তিক দাবি স্বাধীনতার পূর্বকালের। স্বাধীনতাত্তোর ১৯৮৩ সালে একবার এই সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলেও তৎকালীন দামুড়হুদা থানার সকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের কলহ আর ভোটাভুটিতে সে সময় মাত্র এক ভোটে হেরে যায় দর্শনা। উপজেলা হয় দামুড়হুদা। ১৯৯৬ সালে আমাদের বয়:জৈষ্ঠরা নতুনভাবে আবারও দর্শনা উপজেলা দাবিটি উত্থাপন করেন। একটি উপজেলা বাস্তবায়নের জন্য যে রকম অবকাঠামো প্রয়োজন তার সিংহভাগই প্রস্তাবিত দর্শনা উপজেলা সীমানায় বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমানে দর্শনা পৌরসভাতে একটি সরকারি কলেজ, ৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি কিন্ডার গার্টেন, ৪টি মাদরাসা, একটি কেরুজ হাসপাতাল, দুইটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, একটি উপজেলা পশু হাসপাতাল, একটি সরকারি খাদ্য গুদাম, একটি ইক্ষু গবেষণা ইন্স্টিটিউট, একটি ডিজিটাল টেলিফোন একচ্রেঞ্জ, পাঁচটি বেসরকারি মোবাইল বেস স্টেশন, একটি সাব পোস্ট অফিস, একটি ভূমি অফিস, একটি চিনিকল, একটি ডিষ্টিলারী, একটি ফার্মাসিউটিক্যালস্, ৩টি সরকারি ব্যাংক, দুইটি রেলওয়ে স্টেশন, দুইটি জিআরপি ফাঁড়ি, একটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র, একটি বিওপিসহ বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদরের পর দর্শনায় ছিলো এই জেলার প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র। ঐতিহাসিকভাবে আমরা যা পেয়েছি এখন সেগুলোও দিনে দিনে ভঙ্গুর অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে যার কারণে যেটুকু কর্ম-সংস্থানের সুযোগ ছিলো তাও দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র প্রায় নিঃশেষ হবার পথে। স্বাধীনতার পর এমন কোন রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হয়নি যা এই দর্শনা ও পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন সমূহের মানুষগুলোকে একটু উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাতে পারে। এভাবে একটি ঐতিহ্যবাহী শহর না পারছে তার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে-না পারছে আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য কোনো আধুনিক শহর হিসাবে গড়ে তুলতে। এখন নতুন প্রজন্ম মাধ্যমিক স্কুল না পেরোতেই দাবি করে এই শহরে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা নেই, কোন বিনোদন ব্যবস্থা নেই, কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। সেজন্য যার সামর্থ আছে তারা এলাকা ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। যারা পারছে না তাদের সন্তানেরা হতাশা নিয়ে এখানেই দিন কাটাচ্ছে, ভালো শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না, কর্মসংস্থানের কোনো সম্ভাবনা দেখছে না, অনেকে হতাশা থেকে মাদকাসক্ত হচ্ছে। এভাবে অনেক মূল্যবান জীবন আমাদের চোখের সামনে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে। এটাকেই ভাগ্য মনে করে আমরা দিনের পর দিন নিজেরা যেমন বঞ্চিত হয়েছি, তেমনি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি। অন্যদিকে দর্শনার সন্নিকটবর্তী বেগমপুর, তিতুদহ, গড়াইটুপি ও নেহালপুর ইউনিয়নবাসী আরও শোচনীয় অবস্থায় দিন যাপন করছে। তারা চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বাসিন্দা হলেও সংসদীয় নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের ভোটার। ফলে উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক যেকোনো সিদ্ধান্তের আশায় তাদেরকে চেয়ে থাকতে হয় চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের দিকে অন্যদিকে অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক যে কোন সিদ্ধান্তের আশায় তাদেরকে চেয়ে থাকতে হয় চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের দিকে। এ যেন নিজ দেশে পরবাসী, এই বৈষম্যের অবসান দরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ বাসযোগ্য অঞ্চল নির্মাণের দাবিতে তারাও রাজপথে সামিল। উপরোক্ত ইউনিয়নসমূহকে প্রস্তাবিত দর্শনা উপজেলার অন্তর্ভূক্ত করে দ্বৈততার হাত থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্তটা গ্রহণের এখনই উপযুক্ত সময়। কারণ স্বাধীন রাষ্ট্রে এমন দ্বৈততা কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রদত্ত সেবা প্রাপ্তিতে বেগমপুর, তিতুদহ, গড়াইটুপি, নেহালপুর, কুড়ালগাছি ও পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়ন ও দর্শনা পৌরবাসীর যে সাংবিধানিক অধিকার তা থেকে কেন বঞ্চিত হবে। আমাদের দেয়া রাজস্বের টাকায় দেশ আলোকিত হবে, আর আমরা বছরের পর বছর পড়ে রইবো অন্ধকারের অমানিশায়।