পরনির্ভরতা কাটিয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে হাঁটাই শ্রেয়

 

ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনী বিএসএফ’র গুলিতে বাংলাদেশি গরুব্যবসায়ী, গরু পাচারকারীদের রাখালসহ নানা রকমের চোরাচালানীর করুণ মৃত্যুর খবর প্রায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকার পাতায় উঠে আসছে। গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে কিংবা ধরে পিটিয়ে হত্যার পর সীমান্তে মৃতদেহ ফেলে দেয়ার বিষয়টি বন্ধের বিষয়টি ঘুরে ফিরেই উঠে আসে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ভারতের তরফে তেমন প্রতিশ্রুতিও মেলে। বাস্তবে তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না। কেন? অবশ্যই প্রতিটি দেশের সীমান্তরক্ষীদের ওপর অর্পিত মূল দায়িত্ব সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধসহ চোরাচালানী পাচার শূন্যের কোঠায় নেয়া। কোনো কোনো দেশের সীমান্ত প্রহরীদের এজন্য একটু বেশিই দায়িত্ব দেয়া হয়। বেশি দায়িত্বপালনে তাদের অমানবিকতা ফুটে উঠলেও আইন ও সরকারের নীতি ওসব সমর্থন করে বলেই তো সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। ভারত সীমান্তে নাকি সব সময়ই জরুরি অবস্থা বহাল থাকে। অনুপ্রবেশকারীদের হামলাকারী সন্দেহে গুলি করে হত্যা করার নিদের্শনা আছে বলেই তারা গুলি করে পাখির মতো মানুষ মারে। আর আমরা?

দেশে গোমাংসের চাহিদা পূরণে সীমান্তে পাচার করে দেয়া গরু মোষের নিদিষ্ট হারে শুল্ক দিলেই বৈধতা দেয়া হয়। একটি গরু পাচার করে আনলেই মোটা অঙ্কের টাকা লাভ হয়। এ কারণেই গরু পাচার আনতে ছোটে দলে দলে গরু ব্যবসায়ীসহ তাদের রাখালদল। করিডোরগুলো দিয়ে নয়, ভারতের দেয়া তাঁরকাটার বেড়া কেটে কিংবা তাঁরকাটার ওপর বাঁশের অস্থায়ী ব্রিজের মাধ্যমে গরুপাচার করে আনতে গিয়ে অমানবিক গুলিতে অপমৃত্যু হয় তাদের। ওদের অমানবিক প্রাণহানিতে আমাদের তথা দেশবাসীর জন্য মর্যাদাহানিকর হয়ে দাঁড়ায়। অথচ একটু স্বল্পলাভ আর একটু ধৈর্য ধরলেই সীমান্তের চিত্রটা উল্টো হওয়ার কথা। কেমন?

ভারতে গরু উদ্বৃত্ত, আমাদের রয়েছে প্রচুর চাহিদা। তারপরও বৈধপথে পাচার তথা রফতানির ক্ষেত্রে পড়শি বিশাল দেশের রয়েছে ধর্মীয় অনুভূতি সংক্রান্ত বাধা। ফলে চোরাই পথে তা পাওয়ার আশায় আমাদের সীমান্তে গরুপাচারকারীদের একটু সমীহর চোখেই দেখা হয়। বলা হয়, গরু পাচার করে আনার জন্য পরদেশের অভ্যন্তরে যাওয়ার দরকার নেই, ওদের উদ্বৃত্ত গরু ওদেরই কেউ কেউ তা পাচার করবে। তাতে একটু লাভ কম হলেও মরতে হবে না। একটু ধৈর্য ধরলেই ওপারের ওদের অনেকেই গরু নিয়ে কেনার জন্য হাক ডাক পাড়বে। কিন্তু না, এপারের কেউ অতোটুকু ধৈর্য ধরে না। ওপারে অবৈধভাবে ঢুকে গরু আনতে গিয়ে গুলিতে, পিটুনিতে মরে, লজ্জিত হয় জাতি। অবশ্য যারা মরে তাদের সকলেই যে গরু আনতে যায় তাও নয়। ওদের কেউ কেউ মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল চোরাকারাবারী। কেউ কেউ যে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বোমার বারুদ আনতে গিয়ে কিংবা সোনার বার তুলে দিতে গিয়ে মরে না তাও নয়।

চোরাচালান শূন্যের কোঠায় নেয়া আমাদের পক্ষে এখনও অতোটা সম্ভব হয়নি, যতোটা সম্ভব করতে পেরেছে পড়শি দেশ ভারত। সে কারণে কখন ওরা কোনটা চোরাচালানের মাধ্যমে আনা নেয়া করবে তাও ওদেরই মর্জি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেজাজ? কোন সদস্যের যে কখন বিগড়ায় কে জানে? সকল সদস্যের মেজাজের মাত্রা একই রকম থাকলে নিশ্চয় নিশ্চিত মৃত্যু জেনে ওদিকে পা বাড়াতো না কেউ। দালালদের মাধ্যমে দেয়া অর্থেও ওদের কারো কারো মেজাজ ওঠা নামা করে। তা করলেও ওভাবে সীমান্তে প্রাণ হারানো দেশের জন্য লজ্জার। এ লজ্জা, এ কষ্ট থেকে পরিত্রাণে কারোর দয়া দাক্ষিণের দিকে তাকিয়ে না থেকে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে হাঁটাই শ্রেয়। গরুর মাংসের চাহিদা? পূরণ করা অসম্ভব নয়। মাঝে কয়েক বছর ঘরে ঘরে যেভাবে গরু মোটা তাজা করা আর গ্রামবাংলার মহল্লায় মহল্লায় খামার গড়ে তোলা শুরু হয়, তা ধরে রাখতে পারলে পড়শি দেশের ওই গুরুর দরকার হতো না। দুর্ভাগ্য। যখনই দেশে গরু উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে লাগলো, তখনই পড়শি দেশ থেকে গরু পাচারও যেন সহলভ্য হলো। ফলে দেশের ঘরে ঘরে মোটাতাজা করার কাজে লাভের বদলে বাড়লো লোকসান। তাছাড়া দেশের প্রাণিসম্পদ বিভাগও অতোটা নিশ্চয়তা দিতে পারলো না, যতোটা নিশ্চয়তা পেলে খামারিদের খামারের একটি গরুরও অস্বাভাবিক মৃত্যু হবে না। এসব কারণে ঘরে ঘরে গরু পালনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে গুলি করে হত্যার সংখ্যা। গতপরশু রাতেও যশোরের সীমান্তে গুলি করে একজনকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যা বন্ধ হোক।