মারণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ

 

ফারাক্কা শব্দটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে একাত্তরের স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকেই শ্রুত। বলা হয় মারণফাঁদ, ফারাক্কা বাঁধ। পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে পদ্মা নদীর ওপর মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় ভারত এই বাঁধ নির্মাণ করে। যার কাজ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে এবং একই সাথে চালু হয়। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কোলকাতা বন্দরকে পলি জমা মুক্ত রাখার জন্য বাঁধ নির্মাণ হলেও তা ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে। এতে বিশেষ করে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, বন ও নৌপরিবহন ব্যবস্থা ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখিন হচ্ছে। নদীকে এভাবে বেঁধে বাঁধ নির্মাণ বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নিতে পারেনি। এই বাঁধের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কথা বলে আসছে বহু বছর ধরে। কারণ বাঁধের ফলে পানি প্রবাহ কমে গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে। পরিবেশ-প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা। তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করা হয়নি বাঁধ নির্মাণকালে। প্রকৃতিকে এমনভাবে ব্যবহার করা উচিত নয়, যাতে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস হয়। কিছু মানুষের সাময়িক সুবিধার চেয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বৃহৎ স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া উচিত, কোনো নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করা উচিত নয়। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিই বেশি হয় এবং তা যে হয়, তা ভারতের বিহার রাজ্যের মানুষ গত এক দশক ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এই বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই অবস্থান নিলেও এবারই প্রথম ভারতের কেউ সরাসরি এর বিরুদ্ধে অবস্থান শুধু নয়, বাঁধ ভেঙে ফেলার প্রস্তাবও তুলেছেন। বাঁধটি আজ হয়তো বাংলাদেশ বা বিহারের গলার কাঁটা হয়ে রয়েছে। আগামীতে এটা যে গোটা অঞ্চলে বিপর্যয় ডেকে আনবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বিহারে প্রায় ভয়াবহ বন্যার জন্য বিহারের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার সরাসরি ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে বৈঠকে ফারাক্কার কারণে নদীর বুকে পলি জমে বন্যার সৃষ্টি করছে বলে তথ্য-উপাত্ত পেশ করে বাঁধ অপসারণের প্রস্তাব দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তাতে বাংলাদেশের স্বার্থহানি যেন না ঘটে। বাঁধটির ফলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যে খুব উপকৃত হচ্ছে, তা নয়।

ফারাক্কা শব্দটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুল চর্চিত সেই পাকিস্তানকাল থেকেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গঙ্গাসহ সকল নদ-নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকার ভারতের সাথে আলোচনা করেন। ১৯৭৪ সালে দু দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছিলো, গঙ্গায় কম পানি প্রবাহেরকালে সঠিক পানি বণ্টন নিয়ে উভয় দেশ একটি চুক্তি করবে। চুক্তি হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালে শুকনো মরসুমে ভারত পরীক্ষামূলকভাবে একাংশের পানি ছেড়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তা সরকারগুলোও তাদের উত্তরসূরিরা ফারাক্কাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে ভারত বিদ্বেষ প্রচার শুরু করে। খোদ জান্তা শাসকের প্রযোজনায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা লং মার্চ করা হয়। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে ভারতের সাথে কোনো আলোচনাও করা হয়নি। বরং একে ইস্যু করে ভারত বিরোধিতার মাত্রা বাড়ানো হয়। বেগম জিয়া ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারত সফরে গিয়ে গঙ্গার পানি বণ্টনের কথা আলোচনা করতে ভুলেই গিয়েছিলেন বলে দেশে ফিরে জানান। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পেয়ে আসছে। তবে তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হলে শুকনো মরসুমেও পানি মিলবে নদীতে। আর ফারাক্কার গেট খুলে দিলে পানি প্রবাহ গতি পাবে।

ভারত এরই মধ্যে ১০৯টি গেটের মধ্যে ১০৪টি গেট খুলে দিয়েছে। এতে পদ্মা নদীতে পানি প্রবাহ বেড়ে গেছে অধিক হারে। নদী ভাঙনও শুরু হয়েছে। ফারাক্কার সব গেট খুলে দিলে ১১ লাখ কিউসেক পানি সরে যাবে। এ বিষয়ে অবশ্য ভারত তার বাংলাদেশ প্রতিপক্ষের সাথে কথা বলেছে। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন অবস্থাপত্র তৈরির কাজ শুরু করেছে। এরই আলোকে নেয়া হবে পরবর্তী পদক্ষেপ। ফারাক্কা অপসারণে নীতিশ কুমারের প্রস্তাব কার্যকরের আলোচনায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয়। গেট খুলে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি হবে না এমনটাই আশা বন্যা পূর্বাঞ্চলও সতর্কীকরণ কেন্দ্র ও যৌথ নদী কমিশনের। দু দেশের মধ্যে স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা জরুরি। বাংলাদেশ যেন তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত না হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি।