ওই নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড় তোরা সব জয় ধ্বনি কর

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রেম, দ্রোহ, মানবের মুক্তি এবং বিদ্রোহের সুর ও বাণীতে আজীবন সাম্যের কথা বলে গেছেন মানবতাবাদী কবি নজরুল। তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার মর্মবাণী আজও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের প্রেরণা বিদ্রোহ ও তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাকাব্যে ধুমকেতুর মতোই তার আবির্ভাব। কবি বিদ্রোহ করেছিলেন সকল অন্যায়, অসত্য, শোষণ-নির্যাতন আর দুঃখ-দারিদ্র্যেও বিরুদ্ধে। কবিতা লেখার অপরাধে কারারুদ্ধ হন। বন্দি করেও থামানো যায়নি তার লেখা। চরম আর্থিক অনটন আর দুঃখ-দরিদ্র্যেও মধ্যেই তার বাল্যকাল কাটে বলে তাকে সবাই দুখু মিয়া বলে ডাকতো। কবি ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১২ সালে কবি আসানসোলের একটি হোটেলে স্বল্প বেতনে কাজ করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি ও কবি পরিবারকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন ১৯৭২ সালে এবং কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের পূর্বে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীল চাষের রিজিউনাল হেড-কোয়ার্টার ছিলো এই কার্পাসডাঙ্গা। স্বদেশি আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় অন্যতম তিনজন বীর সৈনিক বাবু বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, মোহিম সরকার ও হর্ষপ্রিয় বিশ্বাস ছিলেন এই কার্পাসডাঙ্গার আদি বাসিন্দা। পরে ব্রিটিশ আমলে কোলকাতার আর্মহাস্ট স্ট্রিটের নিজ নিজ বাড়িতে বসবাসের সুবাদে একই মহল্লার বাসিন্দা কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে উল্লেখিত ব্যক্তিদের সৃষ্টি হয়েছিলো একান্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ওই বন্ধুত্বের সম্পর্কের কারণে বন্ধুদের আমন্ত্রণে ১৯২৬ ও ১৯২৭ সালে পর পর দুইবার কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বপরিবারে এই কার্পাসডাঙ্গায় এসেছিলেন। কবির সাথে ছিলেন স্ত্রী প্রমিলা, ২ পুত্র বুলবুল ও সব্যসাচী ও শাশুড়ি গিরিবালা। কবি পরিবার দু-দুবার কার্পাসডাঙ্গা এসেছিলেন। কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থানকালে কবি নজরুল দিনে স্থানীয় মেয়েদেরকে গান শেখাতেন, নিজে লেখালেখি করতেন এবং এলাকার বিভিন্ন মাঠ-প্রান্তর ও গ্রামগঞ্জ ঘুরে বেড়াতেন। এছাড়াও তিনি প্রায়ই গভীর রাত পর্যন্ত এলাকার স্বদেশি আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিয়ে গোপন বৈঠক করতেন। ১৯২৬ ও ১৯২৭ সালে পর পর দু বছর এই কার্পাসডাঙ্গায় কবির উপস্থিতে স্বদেশি আন্দোলনের ভিন্ন ভিন্ন দুটি সমাবেশ হয়েছিলো। কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থানকালীন কবি অবসর সময়ে মিশন স্কুলের বাগান সংলগ্ন ভৈরব নদীর স্নানঘাটের শান বাঁধানো সিঁড়িতে বসে কবি নজরুল রচনা করেছেন অনেক গান, কবিতা ও প্রবন্ধ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হয়েছে- কলসী গেলো ডুবে, কোনো কূলে আজ ভিড়লো তরী/এ কোন সোনার গাঁয় ও পদ্ম গোখরো ইত্যাদি। জাতীয় কবির স্পর্শ ধন্য সেই ভৈরব নদী পাড়ের স্নানঘাটের সিঁড়িটির অংশ বিশেষ এখনো বিদ্যমান আছে। ১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলা হওয়ার পর থেকে জাতীয় কবির স্মৃতি বিজড়িত এই কার্পাসডাঙ্গাকে নজরুল নগরী নামে স্বীকৃতির দাবিতে কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদসহ এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সাংবাদিকরা চেষ্টা চালিয়ে আসছেন।

কবি নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গায় দিনব্যাপি স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। কবির ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কার্পাসডাঙ্গা নজরুল ও শিল্পী সোহরাব হোসেন স্মৃতি সংসদ ওই নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড় তোরা সব জয় ধ্বনি কর স্লোগানকে সামনে রেখে চির উন্নত শির স্মরণ উৎসবের আয়োজনে করে। অগ্নিবীণা চুয়াডাঙ্গা জেলা সংসদের সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আহাম্মদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণানুষ্ঠান উদ্বোধন করেন চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদ প্রশাসক মাহফুজুর রহমান মনজু। প্রধান আলোচক হিসেবে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখেন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান। নজরুল স্মরণানুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ফকির শওকত, কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদের সভাপতি অধ্যাপক এমএ গফুর, ঢাকা বুলবুল একাডেমীর সঙ্গীত শিক্ষক নূরিতা নূসরাত খন্দকার ও কার্পাসডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান ভুট্ট।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাকা অগ্নিবীণা কেন্দ্রীয় সংসদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচএম সিরাজ। নজরুল স্মৃতি চারণ করেন নজরুল স্মৃতি বিজড়িত আটচালা ঘরের মালিক (যে ঘরে কবি এসে থাকতেন) প্রকৃতি বিশ্বাস বকুল। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক সায়ফুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে দেশের ১১ জন বরেণ্য আলোকিত মানুষকে জাতীয় কবি পদকে ভূষিত করা হয়। এরা হলেন- জেলার ৪ জন অফিসার দর্শনা আন্তর্জাতিক চেকপোস্টের ইমিগ্রেশন অফিসার এসআই মাহবুব হোসেন, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই ইব্রাহিম হোসেন, চুয়াডাঙ্গা সদর থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই আব্দুল্লাহ আর মামুন, সদর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই ওহিদুল ইসলাম, নারী সাংবাদিক মরিয়ম শেলী, কার্পাসডাঙ্গার বিশিষ্ট রাজনীতিক এম মফিজুর রহমান ও নসকর আলীকে মরণোত্তর, নজরুল অনুরাগী দামুড়হুদার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান, কবি ও শিক্ষানুরাগী নূরিতা নূসরাত খন্দকার, সমাজসেবায় শেখ নুর মহাম্মদ (যশোর), শিক্ষানুরাগী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ শেখ। অনুষ্ঠানের বিকেলের পর্বে দেশের বিভিন্ন জেলার কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা আবৃত্তি নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ পর্বের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনজুমান আরা।

আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, আলমডাঙ্গায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম শাহাদতবার্ষিকী পালিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংসদ এ উপলক্ষে কবির সৃষ্টি ও জীবন নিয়ে আলোচনা ও বর্ষাকালীন রাগপ্রধান নজরুল সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে। মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি আশরাফুল হকের সভাপতিত্বে গতকাল শনিবার সন্ধ্যারাতে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন- উপজেলা জাসদের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম সরোয়ার, শাহ আলম মন্টু, আনোয়ারুল ইসলাম সাগর, প্রশান্ত বিশ্বাস, রহমান মুকুল, আতিকুর রহমান ফরায়েজী, পিন্টু রহমান, গৌতম কুমার পাল, আতিক বিশ্বাস। উপস্থিত ছিলেন আমিরুল ইসলাম, পান্না মাস্টার, হাবীবুর রহমান, তাজুল ইসলাম। আলমডাঙ্গা কলেজিয়েট স্কুলের উপাধ্যক্ষ শামীম রেজার উপস্থাপনায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন- কমলকান্তি চক্রবর্তী, রেজাউল করিম,রাকিবুল হাসান খান টিটার, পান্না মাস্টার, আশরাফুল হক, গৌতম কুমার পাল, আতিক বিশ্বাস। তবলায় ছিলেন তুষার ও সুশীল কর্মকার। শেষে এক মনোজ্ঞ রাগপ্রধান গানের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। পরে প্রতিযোগিদের পুরস্কৃত করা হয়।

গাংনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহ ও সাম্যের কবি, সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী কবি। সমাজের সব অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন কবি। সাম্প্রদায়িকতা, পরাধীনতার শিকল ভাঙার প্রাণ পুরুষ ও চেতনার কবি সব সময় মিথ্যাকে বাদ দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। মানবতাবাদ নিয়ে অজীবন লিখে যাওয়া কবি এদেশকে সোনার বাংলা নাম দিয়েছিলেন। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুপমণ্ডকতার বিরুদ্ধে তার লেখনী ছিলো অব্যাহত। যার মধ্যদিয়ে পরাধীন জাতির মধ্যে মুক্তির এক অন্যরকম উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিলো। লেখনির মাঝে ছিলো নারীদের প্রতি পুরুষের সম্মানের কথাও। তাইতো অসাম্প্রদায়িক নজরুলের সাম্যবাদী চেতনা বুকে লালন করেই এগিয়ে যেতে হবে বাঙালি জাতিকে। তাহলেই মিলবে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। আঁধার ভেঙে ছড়িয়ে যাবে আলো। এমনই মতামত প্রকাশ করেন মেহেরপুর গাংনীর বিশিষ্টজনেরা। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল শনিবার রাতে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম শফিকুল আলমের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে কবি নজরুলের দর্শন ও সৃষ্টি ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান বক্তারা। তবে তার আগে শিক্ষকদেরকে নজরুল সম্পর্কে ভালোভাবে জানার তাগিদ দেন তারা।

একেএম শফিকুল আলমের সভাপতিত্বে বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও ছড়াকার রফিকুর রশিদ রিজভীর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মুরাদ আলী,  জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি সৈয়দ জাকির হোসেন, প্রভাষক শফি কামাল পলাশ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুল ওয়াদুদ, শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের সহসভাপতি ইয়াছিন রেজা, প্রভাষক সালাউদ্দীন, শহিদুল ইসলাম, শিক্ষক মাজহারুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম।