সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ঢাকা কলেজের তিন ছাত্র চিহ্নিত : হল ছাড়েনি শিক্ষার্থীরা : খোলেনি দোকানপাট
স্টাফ রিপোর্টার: খাবার দোকানের তুচ্ছ ঘটনার জেরে নিউমার্কেট এলাকাজুড়ে লঙ্কাকা-ের নেপথ্যে একাধিক গোষ্ঠীর উসকানির তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাদের সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সন্দেহভাজন অন্তত ১০ জন দোকান কর্মচারী ও হকারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ঢাকা কলেজের কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতারাও আছেন পুলিশের সন্দেহের তালিকায়। পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাতের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ছিল তাৎক্ষণিক। তবে মঙ্গলবার দিনভর থেমে থেমে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের নেপথ্যে উসকানি দিয়েছে অন্তত তিনটি রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন নেতা। তারা একাধিক ‘ছাত্রের লাশ’ ফেলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের নীলনকশায় মেতে উঠেছিল। এ কাজে সফল হলে দায়ভার চাপাতে চেয়েছিল পুলিশের ওপর। এজন্য সংঘর্ষে লিপ্ত ছাত্র ও দোকান কর্মচারীদের নানাভাবে উসকে দেয় তারা। দোকান কর্মচারীদের সঙ্গে মিলে সংঘর্ষে যোগ দেয় বহিরাগতরা। এসব তথ্য জানতে পেরে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ‘নীলনকশায়’ লিপ্তদের কয়েকজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে ঢাকা কলেজ এলাকায় রামদা হাতে বেপরোয়া হেলমেটধারীকে ধরতেও মাঠে নেমেছে পুলিশের একটি দল। এছাড়া সিসি ক্যামেরার ফুটেজের মাধ্যমে ঢাকা কলেজের তিন ছাত্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা সংঘর্ষের ঘটনায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে ব্যবসায়ী-কর্মচারী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনার পর বুধবার পরিস্থিতি শান্ত হলেও পুরোপুরি সচল হয়নি নিউমার্কেট এলাকা। সেখানকার সব মার্কেটের দোকানপাট বুধবার সারাদিন বন্ধ ছিল। ঢাকা কলেজের প্রধান ফটক ছিল তালাবদ্ধ। বিবদমান কোনো গ্রুপই রাস্তায় না থাকায় নতুন করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। পুরো এলাকায় মোতায়েন আছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ। তবে দোকান খুলতে বুধবার সকাল থেকেই ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা মার্কেটগুলোর সামনে জড়ো হয়েছিলেন। আর ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতে অবস্থান করছিলেন শিক্ষার্থীরা। হল ছাড়ার ঘোষণা বুধবার সারাদিনেও কার্যকর হয়নি। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মার্কেট খোলার অনুমতি দেয়নি পুলিশ। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত দোকানপাট খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তবে সকাল থেকেই মিরপুর রোডসহ আশপাশের সব লেন খুলে দিলে স্বাভাবিক হয় যানবাহন চলাচল। বিকেলের দিকে দোকানপাট খোলার চেষ্টা করলে ঢাকা কলেজের সামনে পরপর কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ফের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সতর্ক অবস্থান নেন দোকান কর্মচারী ও হকাররা। কিছু সময়ের জন্য মিরপুর রোডে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পুলিশ, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অন্যদিকে রাত সাড়ে ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দুদিনের সংঘর্ষে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। নিউমার্কেট থানায় মামলাটি দায়ের করা হবে। মামলায় কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান নাহিদকে হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ আনা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে ঘটনার শুরু থেকেই স্থানীয় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ওঠে ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের পক্ষ থেকে। সংঘর্ষের ব্যাপকতা ছড়ানোর জন্য পুলিশের গাফিলতিকে দায়ী করেন তারা। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার কোনো উদ্যোগ নেই।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ এক মুহূর্তের জন্যও নিষ্ক্রিয় ছিল না। বরং সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। অনেকেই উসকানি দিয়ে পুলিশের ভূমিকাকে বিতর্কিত করার পাশাপাশি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করেছিল। তাতে তারা সফল হয়নি। শুরু থেকেই পুলিশ অ্যাকশনে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত। এ কারণে পুলিশ শুরুতে ব্যবসায়ী, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সব মহলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই প্রক্রিয়া কাজে না আসার পর পুলিশ নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।’
জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক এটিএম মাইনুল হোসেন বলেন, ‘ছেলেরা আস্তে আস্তে হল ছাড়ছে। আমরা কাউকে হল ছাড়ার জন্য প্রেসার দিচ্ছি না। ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় এমনিতেই ছেলেরা বাড়ি চলে যাবে।’
সরেজমিন দেখা গেছে, বুধবার সকাল থেকেই নীলক্ষেত মোড়, নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট ও ঢাকা কলেজের প্রধান ফটকসহ আশপাশের এলাকায় মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। এর মধ্যেই দোকানপাট খোলার জন্য ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা মার্কেটগুলোর সামনে জড়ো হতে থাকেন। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনে অর্ধশতাধিক দোকানকর্মী জড়ো হয়ে দোকান খোলার দাবিতে হইচই করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ তাদের বুঝিয়ে শান্ত করে। পরবর্তী নির্দেশ না দিলে দোকান খুলতে তাদের বারণ করা হয়। পুলিশের সিদ্ধান্ত মেনে অনেকেই দোকান না খুলে তাৎক্ষণিকভাবে ফিরে যান। আবার কেউ কেউ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে অপেক্ষা করেন। এক দোকানকর্মী জানান, পুলিশ তাদের দোকান খুলতে নিষেধ করেছে। আবার মালিক পক্ষ থেকেও তারা দোকান খোলার নির্দেশ পাননি। অনেক দোকানকর্মী দোকান খোলার অজুহাতে বাড়াবাড়ির চেষ্টা করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনার পেছনে উভয় পক্ষের দোষ আছে। এত বড় সংঘর্ষের ঘটনা যেহেতু ঘটে গেছে সেহেতু সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই দোকান খোলা উচিত। না হলে ফের পরিস্থিতি খারাপ হলে ব্যবসায়ীদের লোকসানই বেশি হবে। ঈদের আগ মুহূর্তে নিউমার্কেটসহ আশপাশের ১০-১২টি মার্কেট বন্ধ থাকলে দিনে শত শত কোটি টাকার বেচাকেনা থেকে বঞ্চিত হন ব্যবসায়ীরা। তাই দ্রুত দোকানপাট খুলে দেয়ার দাবিও করেন তিনি।
এদিকে মঙ্গলবারের মতো ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের রাজপথে কোনো ধ্বংসাত্মক তৎপরতা ছিল না। শিক্ষার্থীরাও সারাদিনে রাস্তায় নামেনি। কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরের পরিবেশ ছিল থমথমে। ক্যাম্পাসের ভেতর দু-চারজনকে চলাচল করতে দেখা গেছে। প্রশাসনিক ভবনের সামনে ছিল কর্মচারীদের অবস্থান। কলেজের প্রধান ফটক ছিল তালাবদ্ধ। শিক্ষার্থীরা ফটকমুখীও হননি। তবে সকালের বৃষ্টিতে ভিজে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা কলেজের ছাত্রদের পক্ষে সহাবস্থান জানাতে নিউমার্কেট এলাকায় যায়। বৃষ্টিতে ভিজে তারা সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে। পরে পুলিশ বুঝিয়ে তাদের ফেরত পাঠায়।
ঢাকা মহানগন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের (লালবাগ) সহকারী কমিশনার জয়ীতা দাস বলেন, ‘বুধবার সকাল থেকেই মিরপুর রোডে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। কোথাও ছাত্র কিংবা ব্যবসায়ীদের কোনো মুভমেন্ট ছিল না। সবগুলো লেন সচল ছিল।’
প্রসঙ্গত, সোমবার তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে হোটেল কর্মচারী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝামেলার সূত্রপাত হয়। পরে তা রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। পুরো নিউমার্কেট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সোমবার রাতে শুরু হয় সংঘর্ষ থেমে থেমে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত চলে। সংঘর্ষ চলাকালে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় নাহিদ নামের এক পথচারীর। একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান নাহিদ দুপক্ষের মাঝে পড়ে নিহত হন। ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সব ছাত্রাবাস বন্ধ ঘোষণা করেন এবং শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দেন। পরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঢাকা কলেজে ঈদের ছুটি শুরুর কথা জানান। এরপরও অনেক শিক্ষার্থী হোস্টেলে অবস্থান করছেন।
মঙ্গলবার দিনভর থেমে থেমে সংঘর্ষের নেপথ্যে অন্তত তিনটি রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন নেতার যোগসাজশের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নতুন গঠিত একটি রাজনৈতিক দল, বামপন্থি একটি সংগঠন ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা বৃহৎ একটি দলের কয়েকজন নেতা বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে সংঘর্ষে লিপ্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দেন। তারা পুলিশকে একটি ভুল পদক্ষেপের দিকে ধাবিত করতে উসকানি দেয়। তারা একাধিক ছাত্রের লাশ চাচ্ছিল। ধৈর্যহারা হয়ে পুলিশ একটি ভুল সিদ্ধান্ত নেবে-এমন অপেক্ষায় ছিল উসকানিদাতারা। এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ শুরুতে ঘটনাস্থলে তৎপরতা না বাড়িয়ে ব্যবসায়ী ও শিক্ষকদের সামনে এগিয়ে দেয়। ঘটনাস্থলে পাঠানো হয় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের। তাদের মাধ্যমে দুপক্ষকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ কলেজের দিকে এগোলেই ছাত্ররা দশতলার ওপর থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছোড়ে। আবার পেছালে ছাত্ররা কলেজ থেকে বেরিয়ে মার্কেটে হামলার চেষ্টা চালায়। দশতলায় টিয়ারশেল মারা সম্ভব না হওয়ায় সংঘর্ষ দমনে পুলিশের সামনে বিকল্প ছিল গুলি। কিন্তু গুলি করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। তাই পুলিশ সময় নিয়ে সব মহলকে সম্পৃক্ত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এটা পুলিশের একার সিদ্ধান্ত ছিল না বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More