চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জে জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট

সময় বদলালেও আগের মতোই আছে ঝোলাগুড় ও নলেন পাটালির স্বাদ

জহির রায়হান সোহাগ: চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ এগুলেই সরোজগঞ্জ বাজার। সরোজগঞ্জ বাজার থেকে একটু ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। সেই সাথে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। প্রতিবছরের মতো এবারও দেশের বৃহৎ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট জমে উঠেছে সরোজগঞ্জে। গুড় কিনতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন ব্যাপারীরা। সপ্তাহে সোম ও শুক্রবার বসে এ হাট। খেজুরগাছ থেকে সংগ্রহ করা রস দিয়ে তৈরি ঝোলাগুড় ও নলেন পাটালি বেচাকেনার জন্য এ হাটের ঐতিহ্য কয়েকশ’ বছরের। জেলার সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে স্থানীয় সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এ হাটের অবস্থান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। প্রতি সপ্তাহে প্রায় দুই কোটি টাকার গুড় কেনাবেচা হয়। মাটির হাড়ির বা ভাঁড়ের আকার ও ওজন ভেদে দাম ওঠানামা করে। মান ভেদে একভাঁড় গুড় বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকায়। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। অন্যান্য বারের তুলনায় এখানকার খেজুর গুড়ের চাহিদা বেশি থাকায় দামও বাড়ছে।
পুরো এলাকাজুড়ে সাজানো খেজুর গুড়ভর্তি মাটির ভাঁড় ও ছোট ছোট ধামা-কাঠায় নলেন পাটালি। ক্রেতা-বিক্রেতারা তা দাঁড়িয়ে দেখছেন। দরদাম ঠিক হলে ওজন করে ভর্তি করা হচ্ছে ট্রাক। আবার কেউ কেউ নিজের বাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়ি পাঠানোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী কিনছেন। হাটের প্রবেশপথের দু’ধারে বসে কৃষকেরা ধামা-কাঠায় করে তাদের বাড়িতে তৈরি পাটালি বিক্রি করছেন। পাটালির দোকান পার হয়ে ভেতরে যতো যাওয়া যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ততোই চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। সেই সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। হাটের একাধিক স্থানে দাঁড়িপাল্লায় গুড় মেপে হাটে ভেড়ানো ট্রাকগুলোতে গুড়ের ভাঁড় তুলে সাজানো হয়।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর শীত মরসুমে সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড়ের বেচাকেনা হয় এ হাটে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। মরসুমের প্রায় পুরো সময়জুড়েই হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এ হাট। স্থানীয় পাইকার, মহাজন এবং বিভিন্ন মোকাম থেকে আসা ব্যাপারীরা এমনটাই দাবি করেন।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুড় কিনতে সরোজগঞ্জের হাটে আসেন ব্যাপারীরা। ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে গুড় কিনতে এসেছেন শহীদ হাসান। তিনি জানান, দেশের অন্যান্য হাটে এখানকার চেয়ে কম দামে গুড় পাওয়া যায়। তবে, সেসব গুড়ে চিনি মেশানো থাকে বলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা কেউ তা কেনেন না। বেশি দাম জেনেও ব্যাপারীরা ভালো গুড় কিনতে চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জেই ছুটে আসেন। তিনি আরও জানান, আগের হাটের তুলনায় গুড়ের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ১২ থেকে ১৪ কেজি ওজনের এক জোড়া গুড়ের ভাঁড় ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
সরোজগঞ্জ গুড়ের হাটে গুড় বিক্রি করতে আসা চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কালুরপোল গ্রামের গাছি জহুরুল হক জানান, গত দুই দশক ধরে এ হাটে গুড় নিয়ে আসছি। আমাদের কাছ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা গুড় কিনে নিয়ে যান। তবে, গুড়ের ভাঁড়ের দাম বেড়েছে। এ কারণে অনেক সময় কম লাভ হয়।
বাজার কমিটির সভাপতি এম আবদুল্লাহ শেখ জানান, এ হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয় গুড়। প্রতি হাটের দিন গড়ে ২৫০ টন খেজুর গুড় বিক্রি হয়। যার বিক্রয়মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। সরোজগঞ্জ হাটে বিক্রি হওয়া বেশির ভাগ গুড়ই এলাকার কৃষকেরা বাড়িতে যতেœর সঙ্গে তৈরি করেন। এতে চিনি বা কোনো রাসায়নিক নেই। কিছুটা খয়েরি রঙের হলেও এসব গুড় পুরোটাই খাঁটি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, বর্তমানে এ জেলায় ২ লাখ ৫০ হাজারের মতো খেজুরগাছ রয়েছে। যার প্রায় অর্ধেকই সদর উপজেলায়। প্রতি মরসুমে গড়ে ২ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন গুড় উৎপাদিত হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আলী হাসান জানান, মরসুমে প্রতিটি গাছ থেকে অন্তত ১০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসেবে প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন গুড় উৎপাদিত হয়। সরোজগঞ্জ হাট খেজুর গুড়ের প্রধান মোকাম।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More