রহমান মুকুল: করোনাকালের ভয়াল থাবা গ্রাস করেছিল চারিধার। গহন অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল পৃথিবী। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে যখন দিশাহারা সভ্যতা, ঠিক তখনই আলমডাঙ্গার এক পুস্তক ও বেকারির ব্যবসায়ী ওয়াজেদ আলী কচি হয়ে উঠলেন এক আলোকবর্তিকা। দু’হাত ভরে তিনি বিলিয়েছেন ভালোবাসা তিন বছরের বেশি সময়, নিরলস রান্না করা খাবার প্যাকেট করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন গরিব, দুস্থ, পথের মানুষ আর দিনমজুরের হাতে। এই মহৎ কর্মযজ্ঞ আজও থামেনি তার হাতে। প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় তার ভা-ার থেকে, তবুও হৃদয়ে নেই একটুকরো আক্ষেপের ছায়া। কারণ, মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা ভরিয়ে দিয়েছে তাকে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার কলেজপাড়ার এই নিবেদিত প্রাণ ব্যবসায়ীকে। ২০২২ সালের মে মাস, মাত্র ৪৫ প্যাকেট খাবার দিয়ে শুরু হয়েছিল স্বপ্নযাত্রা। আজ সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি রাতে কমবেশি ১৩০ থেকে ১৫০ প্যাকেটে। দিনভর অনাহারে কাতর শ’ শ’ মুখ অপেক্ষা করে থাকেন ওয়াজেদ আলী কচির হাতের একবেলা খাবারের আশায়। নিরন্ন মানুষের করুণ মুখে যখন শিউলি ফুলের মত শুভ্র অন্নের হাসি ফোটে, ওয়াজেদ আলীর হৃদয় তখন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। তৃপ্তির আয়েসি হাসিতে তিনি ছড়িয়ে দেন মানবতার শুদ্ধতম সৌরভ।
পুরানো সেই দিনের কথা: ২০১২ সাল। সে কারণে মীর সময় ওয়াজেদ আলী কচি ব্যবসার প্রয়োজনে ঢাকায় গিয়েছিলেন। তখন একটি ঘটনায় চোখ আটকে যায় তার। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকরা কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশে উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার স্তূপ করে রাখেন। আশপাশের বস্তি থেকে আসা বিভিন্ন বয়সী শিশু, নারী ও পুরুষ সেখান থেকে খাবার বেছে বেছে পলিথিনে ভরছিলেন। তাদের কেউ কেউ আধখাওয়া মাংসের টুকরো মুখে পুরছিলেন। কয়েকটা কুকুর উচ্ছিষ্টের দখল নেয়ার চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারছিলো না। কিছু পাখিকে মুখে করে খাবার নিয়ে উড়ে যেতেও দেখলেন। ওয়াজেদ বলেন, ‘সেদিন খাবার নিয়ে মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে টানাটানির ঘটনায় খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। ওই দিনই ঠিক করেছিলাম, কোনো দিন সামর্থ হলে অসহায়, দুস্থ ও ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দেব। এক সময় শুধু বইয়ের ব্যবসা (ঢাকা বইঘর) ছিল। এখন ঢাকা ফাস্টফুড ও ময়ূরী বেকারি নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এর মধ্যে বেকারি থেকে উপার্জনের প্রায় পুরো টাকা খাবার বিতরণ এবং অন্যান্য সেবামূলক কাজে ব্যয় করি।’
তৃতীয় চোখে: আলমডাঙ্গা নাগরিক উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও তরুণ সমাজকর্মী ডাক্তার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ওয়াজেদ আলী প্রচার বিমুখ একজন মানবিক মানুষ। আমার পরিচিত প্রায় ২০জন হত দরিদ্রকে ৩ বছর ধরে রাতের বেলায় খাবার দিয়ে আসছেন। তার সেবার যে মানসিকতা, তা সত্যিই অনুকরণীয়।’ আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তাপস রশিদ বলেন, ওয়াজেদ আলী অনেক মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। যারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, তাদের এ ধরনের মানবিক কাজে এগিয়ে আসা উচিত।’ খাবারের একটি বড় অংশ বিতরণ করা হয় আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনে। সেখানকার স্টেশন মাস্টার নাজমুল হোসেন বলেন, ‘প্রচারবিমুখ মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে রাতের বেলায় খাবার বিতরণ করে আসছেন। অনেক অসহায় মানুষের চলাচল স্টেশনে। এমনকি অনেক অপেক্ষমাণ যাত্রীর কাছে টাকা থাকে না। তাদের ক্ষুধা নিবারণে খাদ্যসহায়তা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।’
মহতী উদ্যোগে যুথবদ্ধ যারা: ওয়াজেদ আলীর এই মহতী উদ্যোগে সত্যিকার অর্থে সহধর্মিণী সাজেদা খাতুন। ওয়াজেদ আলীর মহতী উদ্যোগে প্রথম থেকে ছায়ার মতো ছিলেন সাজেদা খাতুন। মানবিকতার এই মহাযাত্রায় তিনি শুধু পাশে থাকেননি, সমানভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন মানবিক এ কর্মযজ্ঞ। সাজেদা খাতুন মমতার সুরে ঝঙ্কার তুলে জানান, ‘ক্ষুধার্ত এ মানুষগুলো আজ আমাদের পরিবারের আপনজন। কোনোদিন যদি রান্নার মেয়ে না আসে, আমি নিজ হাতে রান্না করি। রোজার সময় সাহরির জন্যও খাবার পাঠাই। আর ঈদের দিনে? আমরা যেমন পোলাও-মাংস আর মিষ্টিমুখ করি, ওদের জন্যও একই আয়োজন করি।’
ওয়াজেদ আলী কচি জানান, তার মেয়ে শারমিন আক্তার ও জামাতা সিরাজুম মুনীর খান প্রতিমাসে এক দিনের খাবারের ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। এই যাত্রায় সহযাত্রী হয়েছেন আরও অনেকে-বেলগাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম দু’দিনের খাবারের দায়িত্ব নিয়েছেন, ব্যবসায়ী জয়দেব কুমার নিয়েছেন এক দিনের। প্রথম দিন থেকেই নিরলস শ্রম দিয়ে চলেছেন আলমডাঙ্গা বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম, কারখানার কর্মচারী রাজু আহমেদ ও আবদুর রহমান এবং এলাকার শ্রদ্ধেয় মুরব্বি চতুর আলী। খাবার প্যাকেট তৈরির সময় এগিয়ে আসেন আলমডাঙ্গা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ইলিয়াস হোসেন। ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘ওয়াজেদ আলীকে এই সেবামূলক কর্মযজ্ঞ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যে নিষ্ঠা ও সহানুভূতির সঙ্গে দিনরাত কাজ করে চলেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয় এবং অনুকরণীয়।’
এই মানবিক অভিযাত্রার রান্নাঘরে আছেন আফরোজা খাতুন। তার কণ্ঠে গর্বের ঝিলিক-‘প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রান্না হয় ১৫০জনের খাবার। ছয় দিনের চক্রে একদিন মাংস, একদিন মাছ, একদিন ডিম, একদিন সবজি, একদিন ডাল আর একদিন খিচুড়ি পরিবেশন করা হয়।’ মানবতার এই অনির্বাণ প্রদীপ জ্বলছে ওয়াজেদ আলী ও তার সাথীদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর অন্তহীন ভালোবাসায়। ক্ষুধার্ত মুখে হাসি ফুটানোর এই মহাপ্রয়াস হয়ে উঠেছে সমাজের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
ওয়াজেদের ছায়াসঙ্গী হয়ে কাটানো একদিনের দিনলিপি:- আলমডাঙ্গার ভোরে জেগে ওঠে এক প্রাণ, ওয়াজেদ আলী কচি, যিনি সেবায় আঁকেন আপন জগতের গান। প্রত্যুষে তিনি ছুটে চলেন নীরব প্রত্যয়ে। তার তিনটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, তবু লাভের নয়, প্রাণ ভরে তিনি বুনেন সেবার বীজ। বেলা গড়িয়ে ওঠে যখন, ততক্ষণে তিনটি প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের হাতে দায়িত্বের মশাল তুলে দিয়েছেন তিনি। পাশে আবদুর রহমান, দুজনের ছায়া মিশে যায় কাঁচাবাজারের ভিড়ে। সবজির ঝুড়ি, চালের বস্তা, মসলা-মাখা হাওয়া, সবকিছু পৌঁছে যায় বেকারির গোপন চৌকাঠে। যেখানে রান্নার হাঁড়ির ভাপে ভেসে বেড়ায় মানুষের তৃপ্তির স্বপ্ন। জোহরের আজানে তিনি নত হন সৃষ্টিকর্তার সামনে, তারপর শান্তি খুঁজে নেন সাদামাটা খাবারে। আবার ছুটে যান প্রতিষ্ঠানের চার দেওয়ালে, কান পাতেন কর্মযজ্ঞের শব্দে। আসরের আলো ফুরোলে তিনি ফেরেন নিজের গড়া বেকারির কারখানায়। সন্ধ্যার শীতল বাতাসে খাবারের প্যাকেটগুলো ভরে ওঠে ভালোবাসায় মোড়া সুগন্ধে। রাতের আঁধারে দুজন কর্মচারীর মোটরসাইকেলের পেছনে সওয়ার হয়ে ছুটে চলে খাবার ডামোশ, গোবিন্দপুর, মাদারহুদার পথে পথে। ভ্যানের চাকা থামে আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের কংক্রিটের ওপর। উপোসীদের রুগ্ন হাতে হাতে পৌঁছে যায় আশার উষ্ণ প্যাকেট।
ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘দিনশেষে ক্ষুধার্ত মানুষের ঠোঁটে হাসি দেখলে, আমি খুঁজে পাই অদেখা স্বর্গের স্পর্শ।’ এ মেহমানদের কেউ ভাঙা ঘরের চিলেকোঠার সন্তান, কেউ বা একদিন ছিলেন ধনাঢ্য প্রাসাদের রাজপুত্র। কেউ নিভৃত পল্লির হাজি দম্পতি, যাদের সন্তানেরা বিস্মৃত তাদের মায়ের রান্নার গন্ধও। তারা না পারেন অন্যের নিকট হাত পাততে, না পারেন জঠরজ্বালা নিবারণ করতে। এভাবেই মানুষের ক্ষুধায় মেলে তার সন্তুষ্টির রুদ্রাক্ষ। আর লোকচক্ষুর অন্তরালে ওয়াজেদ আলী কচির হাতে রচিত হয় প্রতিদিনের এক অলিখিত মানবতার মহাকাব্য।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.