রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি
স্টাফ রিপোর্টার: করোনার নেতিবাচক প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও অভ্যন্তরীণভাবে চাপে পড়েছে। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও রয়েছে প্রচ- চাপে। সব মিলে চতুর্মুখী চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ইতোমধ্যেই নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৈশ্বিক খাত থেকে সবচেয়ে বেশি আঘাত আসছে অর্থনীতিতে, যা সব দিকে সংক্রমিত হচ্ছে। করোনার পর দেশের ভেতর নানা খাতে নেতিবাচক অবস্থা দেখা দেয়। এর প্রভাবে ব্যাংকের ঋণ প্রবাহ অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায়। বিপরীতে কমে যায় আমানত প্রবাহ। দুই বছর ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত থাকায় ব্যাংকে তারল্য কমেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতায় অনেক ব্যাংক সংকট কাটিয়ে উঠেছে। তবে বেশ কিছু ব্যাংক এখনও তারল্য সংকটে ভুগছে। বিনিয়োগ কমায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গতিও স্থবির। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু সে হারে রপ্তানি আয় বাড়েনি। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাণিজ্য ঘাটতির অংশ মেটানো হয় রেমিট্যান্স দিয়ে। রেমিট্যান্স কমায় সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এদিকে করোনার সময়ে যেসব এলসির দেনা ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত ছিল সেগুলো এখন দিতে হচ্ছে। এদিকে রপ্তানি আয় বাড়লেও অনেক ক্ষেত্রে সেই আয় দেশে আসছে না। সব মিলে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দেয়েছে। এতে বাড়ছে ডলারের দাম। ঘাটতি মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দেওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে রিজার্ভও কমতে থাকে। পণ্যমূল্য ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে টাকার মান কমতে থাকে। একই সঙ্গে কমেছে ক্রয়ক্ষমতা। এতে বেড়েছে মূল্যস্ফীতির হার। সব মিলে চার দিক থেকে অর্থনীতিতে চাপের সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনার সময় প্রায় দুই বছর পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। করোনার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে হঠাৎ করে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এদিকে সরবরাহ কম হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামও বাড়তে থাকে হু হু করে। এ অবস্থায় গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে পণ্যের দাম আবারও লাফিয়ে বাড়তে থাকে। এতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের ভেতরেও। বাড়তি দামে পণ্য আমদানি করায় বিদেশ থেকে মূল্যস্ফীতি আমদানি করেছে দেশ। এতে বাড়তে থাকে এর হার। আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির আশঙ্কা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরুতে এ হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। কিন্তু গত মার্চে এ হার বেড়ে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে উঠেছে। আগামী জুনের মধ্যে এ হার আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে সাউথ এশিয়ান অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে হার দেখায় তা অনেক কম। প্রকৃতপক্ষে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ১২ শতাংশের বেশি।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশিতে পণ্য আমদানি করায় দেশের বাজারেও এর দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল নিয়ে বাজারে অস্থিরতা চলছে প্রায় দুই মাস ধরে। পেঁয়াজ নিয়েও এখন আবার অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এদিকে আটা, ময়দা, চাল, ডালসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। পণ্যেও দাম বাড়ায় কমেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এদিকে করোনার পর অর্থনৈতিক কর্মকা- আগের মতো স্বাভাবিক পর্যায়ে না যাওয়ায় কর্মসংস্থানের হার বাড়েনি। ফলে বাড়েনি বেশির ভাগ মানুষের আয়ও। এতে মানুষের আয় ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে আমদানির নামে বিদেশ থেকে দেশে মূল্যস্ফীতি আসছে, অন্যদিকে দেশের ভেতরে পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতি হার বাড়ছে। এর বাইরে ডলারের দাম বেড়ে টাকার মান কমে যাচ্ছে। এতেও মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়ছে।
করোনার সময় প্রবাসীরা তাদের সঞ্চয়সহ আয়ের অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। ওই সময়ে হুন্ডিবাজদের তৎপরতাও ছিল বন্ধ। চাহিদা না থাকায় ব্যাংকের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ছিল কম। যে কারণে প্রবাসীরা ব্যাংকের মাধ্যমেই রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এতে এর প্রবাহ বেড়েছে। ওই সময়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৬ থেকে ৪০ শতাংশ। ঠিক বিপরীত চিত্র এখন। রেমিট্যান্স বাড়ার পরিবর্তে কমছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই মার্চে রেমিট্যান্স কমেছে ১৮ শতাংশ। এর কারণ, করোনায় যেসব শ্রমিক দেশে ফিরেছেন তাদের অনেকেই ফিরে যেতে পারেননি। বিদেশে যারা আছেন তারাও আগের বেতনে কাজে যেতে পারেননি। এ ছাড়া নতুন শ্রমিক বিদেশে যাওয়ার হার কমেছে। এ ছাড়া হুন্ডিবাজরাও সক্রিয়। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেড়েছে হু হু করে। ফলে রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলের বেশি আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৯৭৩ কোটি ডলার। এপ্রিল পর্যন্ত এসেছে ২০৬০ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে মে ও জুন এই দুই মাসে আনতে হবে ৯১৩ কোটি ডলার, যা অর্জন করা অসম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এক দিকে আমদানি ব্যয় বাড়ায় ডলারের খরচ বেড়েছে। অন্য দিকে রেমিট্যান্স কমায় ডলারের আয় কমেছে। রপ্তানি বাড়লেও তা দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো যায় না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় টান পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এর পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ অবস্থায় এলসি মার্জিন বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া অন্য খাতে রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান বন্ধ করে দেয়া হয়।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ