বিডিপি নামে নতুন দলের পেছনে জামায়াত : নিবন্ধনের জন্য আবেদন

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম নিয়েই এই দল-বিডিপি চেয়ারম্যান : শর্ত পূরণ করে ভিন্ন নামে নিবন্ধন পেতে পারে : ইসি

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে নতুন রাজনৈতিক দল। মূলত এ দল গঠনের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ইসিতে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় তারা নতুন এ নামে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে চাইছেন। এজন্য জামায়াতের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ব্যক্তিদের দিয়ে নতুন দলটির কমিটিও করা হয়েছে। তাদের (বিডিপি) গঠনতন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন ও গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছে। নাম পরিবর্তন করা হলে পরিস্থিতি মোকাবিলা তুলনামূলকভাবে সহজ হবে বলে মনে করেন জামায়াতের একাংশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

বুধবার নির্বাচন কমিশনে ৫০ হাজার পৃষ্ঠার প্রয়োজনীয় তথ্যসহ নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)। দলটির চেয়ারম্যান হলেন অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চান ও জেনারেল সেক্রেটারি মুহা. নিজামুল হক। জানা গেছে, বিডিপি’র চেয়ারম্যানের বাড়ি ময়মনসিংহে। এক সময় তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে জামায়াতে যোগ দেন। তাকে ২০১৯ সালের মার্চে নান্দাইল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময়ও জামায়াত নেতাদের সঙ্গে দেখা গেছে। আর সেক্রেটারি জেনারেল ছাত্র শিবিরের সাবেক বিদেশ বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মপরিষদের সদস্য।

অবশ্য আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিডিপি’র সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কোনো সম্পর্ক নেই। আমিও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। আমাদের কার্যনির্বাহী কমিটি ১৫ সদস্যের।’

দলের গঠনতন্ত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান মেনেই আমরা রাজনীতিতে এসেছি। সংবিধানের প্রতিটি শব্দকেই আমরা সম্মান করি এবং সেটাকে লালন করেই আমরা রাজনীতি করি। বঙ্গবন্ধু তো জাতির পিতা। বাংলাদেশের সংবিধানের বাইরে যেতে রাজি নই। আমাদের গঠনতন্ত্রে সেভাবেই আছে। আর এখানে মুক্তিযুদ্ধের পর জন্ম নেয়া, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম যারা বিভিন্ন জায়গায় উদ্যোক্তা আছেন, তাদের নিয়েই দল গঠন করা হয়েছে।’

বিডিপি’র চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের যত শর্ত আছে সবকিছু পূরণ করে আমরা আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। আশা করি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হব।’ এছাড়া সাংগঠনিকসহ সব বিষয়ে শিগগিরই দলের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানাবেন বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এ প্রসঙ্গে ২৪ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘যখন কোনো কিছু বলার মতো হবে, তখন অবশ্যই জানানো হবে। এটা তো গোপন কিছু নয়, হলে তো আমরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই করব।’

এদিকে বুধবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আলমগীর বলেন, ‘জামায়াতের কেউ যদি যুদ্ধাপরাধী না হন এবং তাদের গঠনতন্ত্র যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে শর্ত পূরণ করে ভিন্ন নামে তাদের নিবন্ধন পেতে বাধা নেই।’

বর্তমান ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের নিবন্ধন কোর্টের আদেশে বাতিল করা হয়েছে। কেউ নিবন্ধিত হতে চাইলে তাকে নতুন করে নিবন্ধিত হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক গঠনতন্ত্র নিয়ে কেউ আবেদন করলে তাদের নিবন্ধন দেবে না কমিশন। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িত, দ-প্রাপ্ত আসামিদের রাজনৈতিক দল হিসাবে নিবন্ধন দেয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান এ নির্বাচন কমিশনার।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। এর ৫ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। নিবন্ধন বাতিলের পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনে বিএনপি’র ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।

তবে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন মামলাটি দেশে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিচারাধীন থাকা অবস্থায় নিবন্ধন বাতিল বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও বেআইনি।’

সূত্রমতে, সর্বশেষ ২২ সেপ্টেম্বর জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের থানা আমিরদের এক বৈঠকে ভিন্ন নামে রাজনীতি করার বিষয়টি জানানো হয়। সেখানে উত্তরের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, ‘ভিন্ন নামে জামায়াতের সংগঠন হবে। আইনজীবীরা নতুন গঠনতন্ত্র নিয়ে কাজ করছেন। তবে এখনই এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়ার প্রয়োজন নেই।’

জানা গেছে, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টিতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির এখনকার নেতাদের কেউ থাকবেন না। নতুন দলে যারা আসবেন বা থাকবেন, তাদের জামায়াত থেকে পদত্যাগ করানো হবে। না হলে রাজনৈতিক কৌশলের কারণে বহিষ্কারও দেখানো হতে পারে।

জামায়াতের একজন উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতা জানান, অন্তত সপ্তাহখানেক আগে জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠকে নতুন নামে দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা ‘অপরিচিত কিছু নেতা’ বের করে নতুন দলের দায়িত্বে আনার জন্য নির্দেশনা দেন। যাদের জামায়াত হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে না, এমন ব্যক্তিদের নতুন দলে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সূত্রের দাবি, নিবন্ধন হয়ে গেলে পরে অপরিচিতদের সরিয়ে মূল নেতাদের সামনে আনা হতে পারে।

জামায়াতের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকার কারণে সরকার তাদের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়ন চালাচ্ছে। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রকাশ্যে আসতে পারছে না দলটি। তাদের প্রভাবাধীন আর্থিক ও সেবামূলক অনেক প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া হয়ে গেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে ঢাকা মহানগরসহ বেশকিছু জেলায় বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করেন জামায়াত নেতারা। আগামী নির্বাচনের আগে যেভাবেই হোক তারা প্রকাশ্যে রাজনীতিতে নামতে চান।

তারা জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত বড় হচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও একাত্তর ইস্যুটিকে সেটেল করার মানসিকতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক এ লক্ষ্য সামনে রেখেই ২০১৯ সালের ১৬ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি দলের দায়িত্বশীলদের চিঠি দিয়ে নতুন দল গঠনের জন্য ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের কথা জানায় হাইকমান্ড। ওই চিঠি দেয়ার আগে শূরার বিশেষ বৈঠকে নতুন দল গঠনের অনুমোদন নেয়া হয়। এরপর করোনা পরিস্থিতিতে এই প্রক্রিয়া কিছুটা থেমে গিয়েছিলো। কয়েক মাস আগে আবারও কাজ শুরু করা হয়। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে নতুন রাজনৈতিক দলের নাম চূড়ান্ত করা হয়।

এ প্রসঙ্গে জামায়াতের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা জানান, নির্বাচন কমিশন যদি নতুন নামে তাদের নিবন্ধন না দেয়, সেক্ষেত্রে তারা নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে সেখানে জমায়েত হতে পারে। সেক্ষেত্রে নিবন্ধিত দলের নামেই তাদের দলীয় পরিচয় হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের আরও কিছু পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন তারা।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More