সীরাতুন্নবী: সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ মডেল মুহাম্মদ (স.)

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী, সিডনি

যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীতে এমন একজনের নাম বলুন যার ভেতর রয়েছে সকল প্রকার ভালো গুণের সমাহার? যার প্রকাশ্য দিবালোকে করা এবং রাতের অন্ধকারে করা আমলের অনুসরণ করা যায়। অনেকেই বিশ্বে অনেক দিক দিয়ে খ্যাতি লাভ করেছেন। কিন্তু কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, আমার সবকিছুকে অনুসরণ করো? বিশ্বের নামী দামী ব্যক্তি যাদেরকে মানুষ রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করে থাকে, তাদের জনসম্মুখের কর্ম ও রাতের আধারে করা কর্ম এক নয়। আসমান-জমিন ফারাক। বিশ্বে একজনই ছিলেন যাঁর সব কিছুকেই অনুসরণ করা যায়। তিনি হলেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (স.)। শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও এই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে।
মহানবী (স.)-এর উন্নত চরিত্র সারা বিশ্বে মানুষের কাছে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। তার জীবনের সর্বত্রই রয়েছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ। তার চরিত্রের প্রশংসা করে স্বয়ং মহান আল্লাহপাক প্রবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রসুলের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ (আল কুরআন)। অন্য জায়গায় আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ইন্নাকা লাআলা খুলুক্বিন আজিম, অর্থাৎ নিশ্চয়ই আপনি মহান ও উন্নত চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত (সূরা কলম: ৪)। খোঁজ নিলে দেখা যাবে বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক মানুষই তার জীবনে কোনো না কোনো মানুষকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। আমার একটা ছোট্ট প্রশ্ন হলো, মহানবী (স.) ছাড়া পৃথিবীতে এমন একটি মানুষও কি কেউ দেখাতে পারবেন? যিনি জীবন চলার সব বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করেছেন অথবা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন? এর উত্তর কেউই দিতে পারবেন না। কারণ, কোন মানুষই আজ পর্যন্ত নিজেকে সার্বিক বিষয়ে মডেল বা আদর্শ দাবি করতে সক্ষম হননি। অথচ মহান আল্লাহতায়ালাই তাঁকে মডেল বা আদর্শ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পেশ করেছেন। আর তিনি কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানুুষের জন্য মডেল বা অনুকরণীয় নমুনা। কোন কোন সাহাবী (যেমন আবু হুরায়রা (রা.) এমন ছিলেন যারা হুজুর (স.)-এর পবিত্র মুখনিঃসৃত কথাগুলো সাথে সাথে লিখে রাখতেন অথবা মুখস্ত করে ফেলতেন। এতে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কিছুটা আপত্তি করেন যে, তোমরা সব কথা লিখে রেখো না; কারণ অনেক সময় মহানবী (স.) রাগের মাথায় অনেক কিছু বলে থাকতে পারেন। এতে মহানবী (স.) উত্তর দিলেন, না তোমরা সব কথায় লিখে রাখতে পারো, কারণ আমি রাগের বশোবর্তী হয়ে কিছু বলি না, যা বলি মহান আল্লা’র পক্ষ থেকেই বলি। মহানবীর (স.) ব্যক্তিগত রাতের জীবন অর্থাৎ তিনি কিভাবে স্ত্রীদের সাথে ব্যবহার করেছেন সেটাও আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ বা সুন্নত। জীবনের এমন কোন দিক নেই যে বিষয়ে তিনি দিক নির্দেশনা দেননি। হাতের নখ কাটা, মাথার চুল কাটা থেকে রাষ্ট্র চালানো পর্যন্ত সব বিষয়েই তিনি শুধু দিক নির্দেশনা দেননি, বরং তিনি তার জীবদ্দশায় তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি একই সঙ্গে আদর্শ যুবক, আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ পিতা, আদর্শ স্বামী, আদর্শ সমাজ সংস্কারক, আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক; এক কথায় সর্ব দিক দিয়েই আদর্শ। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল মানুষের শান্তি, নিরাপত্তা ও সুন্দরভাবে বাঁচার নিশ্চয়তা বিধান করেছে। এমনকি যদি কোন অমুসলিমের প্রতি জুুলুম করা হয়, তাহলে স্বয়ং রহমাতুল্লিল আলামীন হুজুর (স.) জালেমদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করবেন বলে হাদিসে বর্ণিত আছে।
হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি আমার ৮ বছর বয়স থেকে দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ মহানবী (স.)-এর খেদমত করেছি। এর মধ্যে আমি অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু দয়ার নবী কোনোদিন এ কথা বলেননি, এ কাজ তুমি কেন করেছো অথবা একাজ তুমি কেন করোনি? তার পবিত্র বাণী বা হাদিস আজও আমাদের হৃদয়কে আন্দোলিত না করে পারে না। মানবতার মূর্তপ্রতিক, সর্বযুগের, সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হুজুর (স.) হতদরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান করতে গিয়ে এরশাদ করেন, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরাবেন। যদি কেউ কোনো ক্ষুধার্তকে খানা খাওয়ায় আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। আর যদি কেউ কোন পিপাসিতকে পানি পান করাবে মহান আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের মোহরযুক্ত পানীয় পান করাবেন (আবু দাউদ, তিরমিজী)। গরিবদের প্রতি নবীর শিক্ষা, করো না ভিক্ষা; মেহনত করো সবে। তিনি এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না, বড়দের সম্মান করে না এবং আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা করে না; সে আমার উম্মতভুক্ত নয় (তারগীব: আহমাদ, হাকিম))। পিতা-মাতার অধিকার বর্ণনা করতে গিয়ে কড়া তাগিদ দিয়ে তিনি এরশাদ করেন, ওই ব্যক্তির নাক ধুলো-মলিন হোক, ওই ব্যক্তির নাক ধুলো-মলিন হোক, ওই ব্যক্তির নাক ধুলো-মলিন হোক, (আর এক হাদিসে মতে ধ্বংস হোক) যে তার মাতা-পিতা অথবা উভয়ের একজনকে বার্ধক্যে পেল আর সে তাদের খেদমত করে নিজেকে জান্নাতে পৌঁছুতে পারলো না (মুসলিম)। আল্লাহর রসুল (স.) হুকুম দিয়েছেন, তোমরা শ্রমিকের মজুরি দিয়ে দাও তার গায়ের ঘাঁম শুকোনোর আগেই। এটাই ইসলাম। এটাই নবীর শিক্ষা। এভাবেই কায়েম হতে পারে সমাজে শান্তি। অন্য কোনো মতাদর্শে শান্তি আসতেই পারে না। মহানবীর (স.) জীবনের শেষ কথা ছিল এরকম: নামাজ, নামাজ। আর তোমাদের অধীনস্থদের (চাকর-নকর, কর্মচারী, খাদেম, কাজের লোক ইত্যাদি) ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো (আবু দাউদ)। এক হাদিসে তিনি বলেন, তোমরা পরস্পরের প্রতি হিংসাপোষণ করো না, নকল ক্রেতা সেজে আসল ক্রেতাকে ধোঁকা দিও না, ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না, একজনের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর অন্যজন ক্রয়-বিক্রয় করো না। আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা ভাই ভাই হয়ে থাক। মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তাকে জুলুম করতে পারে না, হীন জ্ঞান করতে পারে না এবং অপমান-অপদস্থও করতে পারে না। তাকওয়া এখানে থাকে। একথা তিনি তিনবার বলেন এবং বক্ষের দিকে ইশারা করেন। কোন ব্যক্তি খারাপ প্রমাণিত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে ঘৃণা করে, হীন মনে করে। বস্তুত প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত (জীবন), ধন-সম্পদ, মান-সম্মান অন্য সব মুসলমানের জন্য হারাম (মুসলিম)।
আজকের এই সংকটময় সময়ে যখন সারা বিশ্বে শান্তি নিয়ে হাহাকার, তখন সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, কালজয়ী এক পুরুষ মহানবী (স.)-এর পবিত্র জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শ আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ মডেল। তাই আসুন, আমরা সীরাতুন্নবীর এইদিনে দীপ্ত শপথ নিই, নিজেকে নবীর রঙ্গে রঙিন করি এবং সমাজের সর্বস্তরে তার আদর্শকে ছড়িয়ে দিই। (লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More