জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট : অনিশ্চয়তা ঘনীভূত

স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বহু প্রস্তাবে গঠনমূলক ঐকমত্য গড়ে উঠছে, অন্যদিকে তেমনি এই সংলাপ ঘিরেই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে রাজনৈতিক বিভাজন, হীন কৌশল এবং স্বার্থকেন্দ্রিক অবস্থান। সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। প্রস্তাবগুলো জাতীয় সংসদের মাধ্যমে পাস হবে, নাকি গণপরিষদ গঠন করে তা অনুমোদন হবে-এ প্রশ্ন ঘিরে রাজনৈতিক জটিলতা বাড়ছে। বিশেষত, বিএনপি’র আশঙ্কা, সব বিরোধ সমাধানের পর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন করে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলতে পারে। যার পরিণতি হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করা। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নতুন মেরূকরণ। সংস্কারের পক্ষে থাকা দলগুলো ও পদ্ধতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা দলগুলোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান প্রকট হচ্ছে। ইতিমধ্যে এনসিপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন নানা ইস্যুতে বিএনপিকে ঘায়েল করতে একাট্টা হয়েছে। এর ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের ঐক্যবদ্ধ থাকা দলগুলো পরস্পর পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির হচ্ছে। ২৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আমন্ত্রণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। এ পর্যন্ত মোট ৫৩টি দল আলোচনায় অংশ নেয়, যার মধ্যে ৩৩টি দল সক্রিয়ভাবে সংলাপে যুক্ত হয়েছে। কমিশনের আওতায় দুই দফায় মোট ৫২টি সংলাপ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে উত্থাপিত হয় ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাব। কমিশনের সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী ১০৮টি প্রস্তাবে পূর্ণ একমত, ২৬টি প্রস্তাবে আংশিক ঐকমত্য এবং ৩২টি প্রস্তাবে মতানৈক্য রয়েছে।
সংবিধান সংশোধন, বিচার বিভাগের কাঠামো এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিস্তৃত একমত গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সংবিধানের ৪৮(ক) অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নির্ধারণ; নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠন; নির্বাচন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব কমিশনকে দেয়া; তথ্য অধিকার আইন, দুর্নীতি দমন আইন ও ঔপনিবেশিক আইন সংস্কার; রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনে বোর্ড গঠন এবং বিচার বিভাগের আচরণবিধি ও শৃঙ্খলা কাঠামো প্রণয়ন; সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশন ও ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপে অংশগ্রহণ। তবে সংস্কার সংলাপ ঘিরে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে উঠেছে, তার বিপরীতে কয়েকটি নীতিগত প্রস্তাব দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ও উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি।
আনুপাতিক হারে অন্যদিকে এনসিপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন চায় সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তি যে দল যত ভোট পাবে সেই দল তত আসন পাবে। সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ করার বিষয়ে একমত থাকলেও, মনোনয়ন না সরাসরি ভোটে নির্বাচন হবে- এ নিয়ে বিভাজন এখনো রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা নির্ধারণ (দুই মেয়াদ) কিছু দল কঠোরভাবে চায়, কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে; আইনজীবী সংগঠনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বন্ধে মতভেদ; জাতীয় সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠন নিয়ে সামান্য দ্বিমত; তথ্য অধিকার আইনের আওতায় রাজনৈতিক দলকে আনা বেশির ভাগ দল একমত হলেও কয়েকটি দল দ্বিধান্বিত; জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন বিএনপি’র আপত্তি; বিএনপি’র আপত্তির মুখে এনসিপি গঠনের কাঠামো থেকে ঐকমত্য কমিশন সরে এসে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এখনো এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি। আগামী বৈঠকে তত্ত্ব্বাবধায়ক গঠনের প্রস্তাব উঠতে পারে; উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুনঃস্থাপনে আংশিক মতভেদ রয়েছে;
দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় আরও থাকবে নির্বাচনী সীমানা পুনর্বিন্যাস, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন সংক্রান্ত বিষয়াবলী। কমিশনের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, জুলাই মাসের মধ্যেই ‘জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে। তবে বাস্তবে মৌলিক অনেক বিষয়ে মতৈক্য না হওয়ায় সেই প্রত্যাশা ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে যে গঠনমূলক আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে। সংসদ কাঠামো, নির্বাচন পদ্ধতি এবং ক্ষমতার ভারসাম্য সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে, আসন্ন নির্বাচন ও এর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে-এমন মত বিশ্লেষকদের। সংস্কার সফল করতে হলে দরকার নীতিগত আন্তরিকতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং একটি ঐক্যবদ্ধ সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি। নইলে, এই প্রক্রিয়া রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয়ার বদলে আরও বিভক্তির পথে ঠেলে দিতে পারে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More