চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজেসহ ২৪ কলেজে ২৬ কোটি টাকার অডিট আপত্তি

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী আয়কর কর্তন না করাসহ ৪৮ অনিয়ম

স্টাফ রিপোর্টার: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন দেশের সরকারি কলেজগুলোতে যেন অনিয়মের শেষ নেই। ভুয়া ভাউচারে অর্থ ব্যয়, একই ব্যয় একাধিক খাতে দেখানো, শিক্ষার্থীদের কাছে সরকার নির্ধারিত ফির বেশি অর্থ আদায়, সরকারি বাসা থাকা সত্ত্বেও বাসা ভাড়া গ্রহণ ছাড়াও বিভিন্ন খাতে অর্থ অপচয় করছে সরকারি কলেজগুলো। কলেজগুলো নিয়ে শিক্ষা অডিট অধিদফতরের ২০২০-২১ অর্থবছরের কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। নিরীক্ষা পরিদর্শন প্রতিবেদনের (এআইআর) তথ্য মতে, কলেজগুলোতে ৪৮ ধরনের অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে। এর মধ্যে সাতটি অনুচ্ছেদ গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (এসএফআই) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গুরুতর আর্থিক এসব অনিয়মের জবাব জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদফতর। অধিদফতরের উপ-পরিচালক শাকিলা জামান স্বাক্ষরিত এ চিঠি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। শিক্ষা অডিট অধিদফতরের এই নিরীক্ষা কার্যক্রম গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। শেষ হয় ২৮ ডিসেম্বর।
নিরীক্ষা পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ববর্তী অডিট আপত্তির ব্যবস্থা না হওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আইন না মানার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি দ্রুত বন্ধ হওয়া উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতা, সরকারি বিধান পালন না করায় অনিয়মগুলো সংঘটিত হয়েছে। এমন অনিয়ম রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। নিরীক্ষার সুপারিশে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়েও সুপারিশ করেছে এ অধিদফতর। শিক্ষা অডিট অধিদফতরের উপ-পরিচালক শাকিলা জামানের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২৪টি সরকারি কলেজে নিরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে ২৫ কোটি ৮৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯৫ টাকার অডিট আপত্তি তুলেছে শিক্ষা ও অডিট অধিদফতর। কলেজগুলোতে ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষক ও কর্মচারীদের প্রদানকৃত সম্মানী এবং বিভিন্ন সরবরাহকারীর বিল থেকে আয়কর কর্তন না করায় বা কম কর্তন করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ২২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৮১ টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী আয়কর কর্তন না করায় এ ক্ষতি হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ, রাজধানীর মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ঢাকা, বরগুনার বেতাগী সরকারি কলেজ, ভোলার সরকারি শেখ ফজিলাতুন নেছা মহিলা কলেজ, চরফ্যাশন সরকারি কলেজ, রাজবাড়ীর পাংশা সরকারি কলেজ, জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে এমন অনিয়ম হয় বলে জানা গেছে।
দানপত্র দলিলকালীন (ডিড অব গিফট) অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দেয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৪ টাকা। বরগুনার বেতাগী সরকারি কলেজ, আমতলী সরকারি কলেজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকারের কাছে হস্তান্তরের জন্য ডিড অব গিফট করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ এ নির্দেশনা অনুসরণ না করে প্রতিষ্ঠান তহবিলে জমা রাখে কলেজটি। বিভিন্ন ক্রয়ের বিল থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নির্ধারিত মূসক কর্তন না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ২৯ লাখ ৪৯ হাজার ৪১৩ টাকা। এ অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে রাজধানীর মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, ভোলার সরকারি শাহবাজপুর কলেজ, বরগুনা আমতলী সরকারি কলেজ, কুষ্টিয়া সরকারি সেন্ট্রাল কলেজ ও জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের জন্য সরকার নির্ধারিত বাসা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী সেখানেই অধ্যক্ষদের বসবাস করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সরকারি বাসা থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ বাসা ভাড়া গ্রহণ করছেন। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩৭৫ টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পাবলিক ও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০১ থেকে ১ হাজার হলে ৫ শতাংশ এবং পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজারের বেশি হলে ১০ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি কলেজ সরকারের এ বিধান মানেনি। এসব কলেজের মধ্যে রয়েছে- মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, ভোলার সরকারি শাহবাজপুর কলেজ, বরগুনায় বেতাগী সরকারি কলেজ, রাজবাড়ীর পাংশা সরকারি কলেজ, ভোলার শেখ ফজিলাতুন নেছা মহিলা কলেজ ও ঝিনাইদহের সরকারি লালন শাহ কলেজ। এসব টাকা আদায় করে সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। বেশ কিছু কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে। একই সঙ্গে একাদশ শ্রেণির ভর্তিতে মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত হারের অতিরিক্ত ৫৯ লাখ ৭৭ হাজার ৮২৫ টাকা আদায় করেছে। এছাড়া বেশ কিছু কলেজ বিজ্ঞান ক্লাব তহবিল, ব্যবস্থাপনা ফি, উন্নয়ন ফি, ছাত্র সংসদ ফি, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ফি, লাইব্রেরি ফি খাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে। অতিরিক্ত আদায়কৃত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে প্রমাণ নিরীক্ষা অফিসে প্রেরণ করতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
রাজবাড়ীর পাংশা সরকারি কলেজের ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষায় বিভিন্ন খাতের খরচ রাজস্ব এবং কলেজ তহবিল উভয় খাতে দেখানোয় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার ১০০ টাকা। এ ঘটনায় দায়ী কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে এসব টাকা আদায় করে সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। কলেজটির জাতীয়করণকৃত শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণের আগে কলেজ তহবিল গৃহীত টাকা ফেরত বা সমন্বয় না করে বকেয়া বেতন-ভাতা বাবদ অতিরিক্ত গ্রহণ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ২৬০ টাকা। এই কলেজটি এমপিও কলেজ ও কর্মচারীদের নিয়ম বহির্ভূতভাবে আত্তীকরণ করে বেতন নির্ধারণ করে নিয়মিত বেতন পরিশোধ করে আসছিল। এ জন্য সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ ৮৫ হাজার ৩০৭ টাকা। কলেজটি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে আদায়কৃত টাকার মধ্যে ব্যাংক হিসাবে কম জমা করায় আর্থিক অনিয়ম করেছে ২ কোটি ৫৯ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫ টাকা। শিক্ষা অডিট অধিদফতর বলছে, এসব ঘটনায় দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত এ কলেজের অধ্যক্ষ ঢাকায় যাতায়াত দেখিয়ে ভ্রমণ আদেশ ছাড়াই কলেজ তহবিল থেকে ৭৯ লাখ ৭ হাজার ৮০৮ টাকা উত্তোলন করেছেন, যা জেনারেল ফিন্যান্সিয়াল রুলসের লঙ্ঘন। শিক্ষা অডিট অধিদফতরের পরিচালক মোহাম্মদ আমীমূল এহসান কবীর এ প্রসঙ্গে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন আর্থিক অনিয়ম কাম্য নয়। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়মগুলো চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাব জানতে চাওয়া হয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More