নাগরিকবান্ধব একটি আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার জন-অভিপ্রায়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে। এ কমিশনের গত বুধবারের বৈঠকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ এবং এনসিসি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সংবিধানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সুবিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্প্রীতি ও পক্ষপাতহীনতা-এই সাতটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনায় বেশির ভাগ দল একমত হলেও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। অনেক বিষয়ে একমত না হলেও আশার কথা হলো-প্রধানমন্ত্রী পদে কোনো ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, সংবিধানে এমন বিধান যুক্ত করার বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। এতে করে একটি বড় বিষয়ে একমত হলো রাজনৈতিক দলগুলো। আর নারীদের জন্য ১০০ আসন এবং সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্যসংখ্যা ১০০ জন এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগে ‘জ্যেষ্ঠতম দু’জনের’ মধ্যে যে কোনো একজনকে নিয়োগের বিষয়েও ঐকমত্য হয়েছে। তবে সংস্কারের আরেক মৌলিক বিষয় সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) মতো প্রতিষ্ঠান গঠনে ঐকমত্য হয়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’-নামে নতুন কাঠামো রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতির নাম বাদ রাখা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান বৈঠকের ষষ্ঠ দিনের আলোচনা শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এনসিসি প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে। নতুন প্রস্তাবিত কমিটির কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) পরিবর্তে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কমিটি শুধু সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগকার্যক্রম পরিচালনা করবে। অ্যাটর্নি জেনারেল ও তিন বাহিনীর প্রধানের নিয়োগ এ কমিটির অন্তর্ভুক্ত হবে না। তিনি বলেন, যেহেতু সংবিধান এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে এখনো উপনীত হওয়া যায়নি, তাই প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাচ্ছে না। আমাদের বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ করে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পর ক্ষমতার ভারসাম্য বলতে কিছু ছিলো না। বাস্তবে এক ব্যক্তি অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব মর্জিমাফিক দেশ চালিয়েছেন। বলা যেতে পারে, দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রী দ্বারা শাসিত হয়েছেন। ফলে শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচারের জন্ম হয়েছে দেশে। শেখ হাসিনার সৃষ্ট ফ্যাসিবাদী জমানায় দেশে দুর্বিষহ পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো। এ অসহনীয় অবস্থা থেকে জাতির মুক্তি মিলেছে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনে। লক্ষণীয় হলো-শেখ হাসিনার পতনের পর আমাদের জাতীয় জীবনে এখন জনবান্ধব একটি কল্যাণ রাষ্ট্র্রের জন-অভিপ্রায় প্রবলভাবে উপস্থিত। এই অভিপ্রায় বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্তরিক হতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর স্মরণে রাখতে হবে, যেসব রাজনৈতিক দল জনপ্রত্যাশা ধারণ করতে পারবে না তারা রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং দুর্বিনীত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে দুই মেয়াদের বেশি এক ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রীর পদে না থাকার বিষয়ে রাজনৈতিক যে ঐকমত্য হয়েছে; তাতে জাতি আশাবাদী হয়ে উঠেছে-বাদবাকি মৌলিক বিষয়ের সংস্কারেও সবাই একমত হবেন।
পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.