মিটফোর্ড হত্যাকা- : দায় এড়াবেন কিভাবে

গত বুধবার পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত মিলে যেভাবে এক ব্যবসায়ীকে নৃশংস ও নারকীয় কায়দায় হত্যা করেছে, তাদের ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এ ব্যবসায়ীর নাম লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ। পুলিশ বলছে, এলাকার ভাঙারির ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে বিরোধের জেরেই দুর্বৃত্তরা এ হত্যাকা- ঘটায়। এ পাষ-রা সোহাগকে কুপিয়ে ও শরীর-মস্তক পাথরে থেঁতলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তার লাশের ওপর নৃত্য করতেও দ্বিধা করেনি। মানুষ এত বর্বর ও নিষ্ঠুর হয় কী করে! সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, আশপাশের লোকজন হতবিহ্বলে সোহাগ হত্যা প্রত্যক্ষ করলেও এগিয়ে আসেননি। নির্বিকার ছিলেন হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যরাও। আমরা কেমন সমাজে বাস করছি, যেখানে অপরাধের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন না? অতীব উদ্বেগের বিষয়, এই হত্যাকা-ের সঙ্গে বিএনপির যুব সংগঠন যুবদলের স্থানীয় নেতা-কর্মী জড়িত বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় প্ররোচনায় অনেক হত্যাকা- হয়েছে। এই পুরান ঢাকায়ই বিরোধী দলের হরতাল কর্মসূচি বন্ধ করতে বিশ্বজিৎ দাস নামের এক দরজিকেও কুপিয়ে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা। এরপর তাদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। কিন্তু চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরও যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, সাম্প্রতিক হত্যাকা-গুলো তার প্রমাণ। গত শুক্রবার খুলনার দৌলতপুরে যুবদল থেকে বহিষ্কৃত নেতাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত, চার মাসে রাজধানীতেই খুন হয়েছেন ১৩৬ জন। সারা দেশে এই সংখ্যা ১২ শতাধিক। অন্যদিকে ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ঢাকায় এ সংখ্যা ছিলো ৫৫, ২০২২ সালে ৫৪, ২০২৩ সালে ৫১ ও ২০২৪ সালে ৪৭। সোহাগ হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাকায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পাঁচজনকে গ্রেফতার করাকেই সরকারের সাফল্য বলে দাবি করেছেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল অপরাধীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হত্যার বিচার করার কথা বলেছেন।
কিন্তু তাদের আশ্বাস ও অঙ্গীকার কেন অপরাধ কমাতে পারছে না? সাম্প্রতিক কালে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর হত্যাকা- ঘটেছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও চলছে। সোহাগ হত্যার ঘটনায় যুবদল সভাপতি সংবাদ সম্মেলন করে মামলা থেকে বাদীর এজাহারভুক্ত তিন আসামিকে বাদ দেয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ তুলে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তার এই প্রশ্নের যথার্থতা স্বীকার করে বলব, যে সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় এ রকম খুনি তৈরি হয়, সেই সংগঠন কি খুনের দায় এড়াতে পারে? রাজনৈতিক দলগুলো তাদের যেসব নেতা-কর্মী হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের বহিষ্কার করেই দায়িত্ব শেষ করছে। কিন্তু কীভাবে দলের আশ্রয়ে তারা দুর্ধর্ষ অপরাধীতে পরিণত হচ্ছেন, সেই প্রশ্ন নিজেদের করছেন না।
একের পর এক নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মমাফিক কার্যক্রমের বাইরে কিছু করছে না। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও নিয়োজিত আছেন। অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও পক্ষপাতমূলক। লালমনিরহাটের পাটগ্রামে আসামি ছিনতাই করার দায়ে সরকার স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু চট্টগ্রামের পটিয়ায় যারা পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হলেন, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা আইনের শাসনের পরিপন্থী। অপরাধীদের দমন করতে হলে আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায় এড়ানোর মনোবৃত্তি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More