একজন কিংবদন্তির মহাপ্রস্থান : হারালাম আবুল কাশেম মাস্টারকে

রহমান মুকুল/মুর্শিদ কলিন/সোহেল হুদা: আলমডাঙ্গা আজ কাঁদছে। শোকস্তব্ধ হাটবোয়ালিয়া। বেদনার ভারে নুয়ে আছে গাংনী-মিরপুর। এক অনন্য মানুষ চলে গেলেন চিরনিদ্রায় কবির মতো নিঃশব্দ, মুক্তিযোদ্ধার মতো গর্বিত, আর শিক্ষক হিসেবে অসংখ্য হৃদয়ে অমর হয়ে। চুয়াডাঙ্গা জেলার হাটবোয়ালিয়া গ্রামের সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া শিক্ষক, সাহিত্যিক, সংগঠক এবং সংস্কৃতির জীবন্ত বাতিঘর আবুল কাশেম মাস্টার আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল সোমবার বিকেল ৫টায় স্ট্রোক করে তিনি যখন ঢলে পড়লেন মৃত্যুর দিকে, তখনও কেউ ভাবেনি এই হেসে হেসে জীবন সাজানো মানুষটি এভাবে হঠাৎ থেমে যাবেন! চন্দ্রপ্রভা নামের বাসভবনেই তার জীবনের সূর্য অস্ত গেলো। আলমডাঙ্গা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছানোর আগেই নিভে যায় তার প্রাণপ্রদীপ। বয়স হয়েছিল ৭১ বছর-একাত্তরের এক বীর যোদ্ধার জীবনের শেষ প্রহরেও যেন এক গৌরবময় সংখ্যা জ্বলজ্বল করছিল। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, তিন পুত্র, অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী, সুহৃদ এবং শ্রদ্ধাভাজনজন। কিন্তু রেখে গেছেন আরও কিছু একটা প্রজন্মের আস্থাভাজন একজন শিক্ষক, সাহসী একজন মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ এবং সাহিত্যের একজন ক্ষণজন্মা সাধক। একজন প্রশংসনীয় উপস্থাপক। আবুল কাশেম মাস্টার ছিলেন হাটবোয়ালিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক। কিন্তু তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন অনুপ্রেরণা। তিনি ছিলেন খেলাধুলার মাঠে তরুণদের আত্মবিশ্বাসের উৎস। গাংনী, মিরপুর, আলমডাঙ্গা এই তিন উপজেলার ক্রীড়াপ্রেমীরা জানে, “স্যার ছিলেন আমাদের ক্রীড়া শিক্ষকদের শিক্ষক!” তার হাতে গড়ে উঠেছে বহু খেলোয়াড়, বহু ক্রীড়া সংগঠক। মাঠে যাদের পদচারণা এখন, তারা অনেকেই একদিন ছিলেন কাশেম স্যারের ছাত্র। শুধু খেলাধুলা নয় তিনি ছিলেন সাহিত্য সংস্কৃতির জ্বলন্ত প্রদীপ। নিজে কবিতা লিখতেন, আবৃত্তি করতেন। সাহিত্য নিয়ে ছিল তার এক অন্তরঙ্গ সখ্য। হাটবোয়ালিয়া কিংবা গাংনীতে অনুষ্ঠিত বহু সাহিত্য সম্মেলনের কান্ডারি ছিলেন তিনি নিজেই। সঙ্গীত চর্চায় তিনি উৎসাহ দিতেন নিঃস্বার্থভাবে। তার ছায়াতলে বেড়ে উঠেছে অনেক কণ্ঠ। তার উৎসাহেই সংগীতাঙ্গনে এসেছিলেন ক্লোজআপ ওয়ান খ্যাত শিল্পী বিউটি। তিনি ছিলেন সংস্কৃতির এক পরিপূর্ণ অভিভাবক। আলমডাঙ্গার হারিয়ে যেতে বসা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার প্রয়াস ছিল তাঁর অন্তরভরা স্বপ্ন। কখনও শহরে এসে নাটক, গান, আবৃত্তির আড্ডায় প্রাণ জোগাতেন, তরুণদের পাশে থাকতেন প্রেরণার বাতাস হয়ে। তিনি ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। পাহাড়-নদী-হাওর তাঁর কাছে ছিল প্রেরণার পাথেয়। কখনও একদল তরুণকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেন দূরের পাহাড়ে।
সম্প্রতি তিনি যেতে চেয়েছিলেন সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। কিন্তু তার আগেই তিনি পাড়ি জমালেন আরও দূরের এক অজানা গন্তব্যে, যেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসে না। আজ মঙ্গলবার সকালে হাটবোয়ালিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। কান্নাভেজা চোখে মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানাবে প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় কবি, প্রিয় মুক্তিযোদ্ধাকে। এরপর, নগর বোয়ালিয়া-কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে। সালাম আর অশ্রুসিক্ত বিদায়ে চিরতরে সমাহিত হবেন এক কিংবদন্তী। আজ চারপাশে শুধু হাহাকার একটি সুর থেমে গেছে, একটি কণ্ঠ নিস্তব্ধ, একটি হৃদয় আর কারও জন্য উন্মুখ নয়। আলমডাঙ্গা এক প্রাণপুরুষকে হারালো। আর সবাই হারালাম এক ভালোবাসার মানুষকে। আবুল কাশেম মাস্টার ছিলেন ছিলেন আলোকবর্তিকা। তার মতো মানুষ বারবার জন্মায় না। মহাপ্রস্থানের পরও তিনি রয়ে যাবেন শত শত ছাত্রের মনে, সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে, আর মাঠের প্রতিটি বাঁকে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More