চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহে মৌন মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়

স্টাফ রিপোর্টার: জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ছাত্র-জনতার স্মরণে ও তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় মৌন মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছে বিএনপি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল শুক্রবার চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহসহ সারাদেশে মৌন মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছে। সমাবেশে ‘জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে শহিদদের আত্মার মাগফিরাত ও আহতদের সুস্থতা কামনা করে বক্তারা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জুলাই শহিদরা আমাদের হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন। আগামীর বাংলাদেশ হবে সন্ত্রাসমুক্ত, মাদকমুক্ত, বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ। তারেক রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় জুলাই শহিদদের স্বীকৃতির ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে শহিদ পরিবারের পাশে থাকবে বিএনপি। বক্তারা আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই অবিলম্বে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে গণআন্দোলনে যেসব ফ্যাসিস্টবাহিনী হামলা চালিয়েছে তাদের বিচার করা হবে।’ তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘সন্ত্রাস দমন করতে হলে দলমত নির্বিশেষে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। মেহেরপুরে কোনো টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি বরদাশত করা হবে না। প্রশাসনকে বলছি-তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনুন।’ বক্তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কটূক্তির প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘যারা তারেক রহমানকে নিয়ে অপপ্রচার করছে, তাদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’ তারা আরও বলেন, গোপালগঞ্জে উসকানিমূলক সহিংসতা প্রমাণ করে শেখ হাসিনা ও তার দোসররা এখনো দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা এখনো স্বপ্ন দেখে আবার ক্ষমতায় ফেরার। কিন্তু এদেশের মানুষ আর আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মেনে নেবে না। জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশের প্রতিটি প্রান্তে বিএনপির নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। তাদের দেখলেই প্রতিহত করা হবে।
চুয়াডাঙ্গায় গতকাল শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায় সাহিত্য পরিষদ চত্বর থেকে মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহিদ হাসান চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ। মৌন মিছিল ও সমাবেশে অংশ নেন চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী। অনেকে শহিদদের স্মরণে কালো ব্যাজ ধারণ করেন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা মির্জা ফরিদুল ইসলাম শিপলু। সঞ্চালনায় ছিলেন আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক সফিকুল ইসলাম পিটু। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও সিনিয়র নেতা খন্দকার আব্দুল জব্বার সোনা। এছাড়া আরও বক্তব্য দেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ মিল্টন, দর্শনা থানা বিএনপির সভাপতি খাজা আবুল হাসনাত, সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান লিপ্টন, পৌর বিএনপির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মনি, দামুড়হুদা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির এবং আলমডাঙ্গা পৌর বিএনপির সভাপতি আজিজুর রহমান পিন্টু। মৌন মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন, দামুড়হুদা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল হাসান তনু, আলমডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আখতার হোসেন জোয়ার্দার, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রোকন, চুয়াডাঙ্গা পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক পল্টু, দর্শনা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ আলী, চুয়াডাঙ্গা পৌর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি রাফিতুল্লাহ মহলদার, দামুড়হুদা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রফেসর আবুল হাসেম, সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক মহাবুল হক মহাবুব। এছাড়া অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জেলা মহিলা দলের সভাপতি রউফ উর নাহার রিনা ও সাধারণ সম্পাদক জাহানারা পারভীন, জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক মোকাররম হোসেন ও সদস্যসচিব এবং বাড়াদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোবারক হোসেন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক এম.এ. তালহা, জেলা মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক কামরুজ্জামান বাবলু, জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহেদ মোহাম্মদ রাজিব খান, জেলা জাসাসের সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিমুল হাবিব সেলিম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম হাসান টুটুল, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি শাহজাহান খান ও সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর রহমান মোমিনসহ জেলার বিভিন্ন ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণ এবং বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী।
এদিকে, জুলাই শহিদদের স্মরণে মিলিমা ইসলাম বিশ্বাসের নেতৃত্বে মৌন মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেতা রবিউল ইসলাম বাবলু, থানা বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজি আব্দুল খালেক, চুয়াডাঙ্গা পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি আরঙ্গজেব বেল্টু, জেলা বিএনপির সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক মো. মমিনুল ইসলাম মুকুল বিশ্বাস, মহিলা নেত্রী সেলিনা বেগম, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, বিএনপি নেতা শাহিন, আশরাফুল, মোহাম্মদ নিজাম, মিজানুর, জাহিদ হাসান কালু, লিখন, মালেক, ২নং ওয়ার্ড বিএনপির ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আবু বক্কর, যুবদল নেতা মফিজুল ইসলাম, ৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক বিপ্লব, আলমডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক ফরহাদ হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন, মোহাম্মদ ঝন্টু, আসাদুল হক, মোহাম্মদ বকুল, একুব্বার, কাবিল, কালাম, কালাম, ঝন্টু, মহির উদ্দিন, বিল্লাল, আমির, হায়াত আলী, আহাদ, সোহরাব, আহাদ, নাজমুল, জর্জ, সোহরাব আলি, মহিদুল, শফি, রাজ্জাক, নেয়ামত, শহীদ, ইবলু, রুহুল, জানারুল, টগর, ইমন, আনোয়ার প্রমুখ।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো দমন-পীড়নে নিহত শহিদদের স্মরণে মেহেরপুর জেলা বিএনপির উদ্যোগে এক মৌন মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে এই মৌন মিছিল শুরু হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে সাহাজি পাড়ার মোড়ে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলহাজ্ব জাভেদ মাসুদ মিল্টনের নেতৃত্বে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে আরও উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আমিরুল ইসলাম, যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়েজ মোহাম্মদ, সদস্য ইলিয়াস হোসেন, আনসারুল হক, আলমগীর খান ছাতু, সদস্য আবু সালে নাসিম সাবেক পিপি ওমর ফারুক লিটন, আখেরুজ্জামান, মকবুল হোসেন মেঘলা, রেজাউল হক, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী মিজান মেনন, জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক কাওছার আলী, জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বিপ্লবসহ জেলা বিএনপি এবং অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল ও সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহিদদের স্মরণে ঝিনাইদহে মৌন মিছিল করেছে জেলা বিএনপি। মিছিলে বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টায় জেলা বিএনপির কার্যালয় থেকে মৌন মিছিল বের হয়। জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট এমএ মজিদের নেতৃত্বে মৌন মিছিলটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে শহরের পোস্ট অফিস মোড়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয় নেতাকর্মীরা। এসময় উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনা, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ বিশ্বাস, সহ-সভাপতি মুন্সি কামাল আজাদ পান্নু, এনামুল হক মুকুল, যুগ্ম সম্পাদক এম শাহজাহান, যুবদলের সভাপতি আহসান হাবীব রনক, সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম পিন্টু, মহিলা দলের সভাপতি অধ্যক্ষ কামরুন্নাহার লিজি, সাধারণ সম্পাদক তহুরা খাতুন, ছাত্রদলের সভাপতি সমিনুজ্জামান সমিন, সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর রহমান মানিক প্রমুখ।

কবিতায় টিকে থাকলেও প্রকৃতিতে নেই আর চিহ্ন : হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার বন-ঐশ্বর্য
– রহমান মুকুল:
বাংলার প্রকৃতি এক সময় ছিল ফুলে-ফলে, পাখি আর ছায়ায় পূর্ণ। প্রতিটি গ্রাম ছিল ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, শস্য শ্যামলা। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকত হিজল, মাঠের পাশ দিয়ে ছায়া দিত বাবলা, মেয়ের রূপবর্ণনায় আসত কুচ গাছের ফল। আজ এসব গাছ যেন কেবল কবিতায় বা লোককথায় টিকে আছে। বাস্তবে তারা একে একে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
হিজল: নদীর প্রান্তে এক নির্জন সৌন্দর্য যেন হিজল। নদী কিংবা খালের ধারে জন্মানো হিজল গাছ বর্ষায় পানির দিকে ঝুঁকে পড়ে। মনে হয় অথৈ জলে বুক ডুবিয়ে প্রাণের জ্বালা মেটাতে চায়। নব্বইয়ের দশকের কবি মাহবুব কবিরের ‘হিজলজন্ম’ কবিতা কিংবা নজরুলের। “হিজল তমাল ডালে ঝুলনা ঝুলায়ে/তাপিত ধরার চোখে অঞ্জন বুলায়ে” উক্তি বলে দেয় গাছটি কেবল উদ্ভিদ নয়, এক প্রাণময় অনুভব। কিন্তু বর্তমানে দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে হিজল গাছ এখনও টিকে থাকলেও আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে দেখা পাওয়া দায়।
বিশেষজ্ঞ মত: ড. রাকিব হাসান, পরিবেশ ও বন গবেষক, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বন ও পরিবেশ গবেষক ড. রাকিব হাসান বলেন, “হিজল নদীতীরবর্তী ইকোসিস্টেমের অংশ। নদী ভরাট, বাঁধ নির্মাণ, খালপাড়ের দখলের ফলে গাছটি বিলুপ্তির পথে।”
বাবলা: সহজ গাছ, অমূল্য অবদান। বাবলা গাছ আগে পথঘাটে, মাঠে-ঘাটে অবহেলায় বেড়ে উঠত। এর হলুদ ফুলে ভরা গাছ, ছায়া আর ফলের ছড়া গবাদিপশুর খাদ্য হতো। অযতেœ রাস্তার দুপাশে, পতিত জমিতে অবহেলে জন্মাতো। কবি নজরুল লিখেছেন: “এনে দে মাঠ থেকে, কিনে দে হাট থেকে/বাবলার ফুল, আমের মুকুল/ নইলে বাঁধব না বাঁধব না চুল।”
বিশেষজ্ঞ মত:
রাশেদা কবির জানান, (সহকারী অধ্যাপক, বোটানি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) “বাবলা গাছকে আগাছা ভেবে রাস্তার পাশে কেটে ফেলা হচ্ছে, অথচ এটি মাটির অনুর্বরতা রোধে ও পশুখাদ্যে দারুণ উপযোগী।”
কুচ: রূপ-রস ও মাপজোকের প্রতীক: “কুচ বরণ কন্যা রে তার মেঘ বরণ কেশ”—নারীর রূপের উপমা ছিল কুচ ফলের রঙ। শুধু রূপতুলনাই নয়, এক সময় স্বর্ণ পরিমাপেও ‘কুচ’ ব্যবহৃত হতো। এক ভরি সোনার ৮০ ভাগের এক ভাগ ছিল এক কুচ। এখনো কোনো কোনো স্বর্ণকারের মুখে এর ব্যবহার শোনা যায়। অথচ, লতা শ্রেণির এই গাছ আজ হারিয়ে গেছে বললেই চলে।
বিশেষজ্ঞ মত: জাহিদুর রহমান তুষার জানান, (পুরাতত্ত্ববিদ ও লোকসংস্কৃতি গবেষক, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর) “কুচ গাছ শুধু উদ্ভিদ নয়, তা আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমাপ ও রূপতত্ত্বের অংশ। অথচ আজ তা লোকচক্ষুর আড়ালে।”
বৈচি: লোকসাহিত্যের গন্ধমাখা গাছ এটি। বৈচি কাঁটা প্রেমের বাঁধন হয়ে এসেছে নজরুলের গানে: “চলিতে পেঁইচি কি হাতের, বাঁধিল বৈচি কাঁটাতে?” বৈচি গাছ ঝোপে, মাঠে নিজে থেকে জন্মাত। এর পাকা রসাল ফল পাখির সাথে সাথে শিশু ও কিশোরদের প্রিয় ছিল। এখন এসব জমি আবাসিক বা কৃষি উন্নয়নের দখলে। ফলে বৈচি গাছ বিলুপ্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মত: খালিদ আহসান (নির্বাহী পরিচালক, পরিবেশ অধিকার পরিষদ) জানান, “বৈচি গাছ নিজে থেকে জন্মাতো, কিন্তু আজ তার জন্য কোনো জমিই অবশিষ্ট নেই।”
কেয়া: সুবাসে ঘেরা ফুলের নিঃশব্দ বিদায় যেন। কেয়া ফুল ঝোপে ঝোপে গন্ধ ছড়াতো।
নজরুল লিখেছেন: “দিলো কি পূব হাওয়াতে দোল, বুকে কি বিঁধিল কেয়া?” ঝোপে বনে বাদাড়ে অবহেলায় জন্মাতো। কিন্তু ফুল ফুটলে তার তীব্র সুগন্ধ বন বাদাড় এমনকি এলাকাজুড়ে গন্ধ ছড়াতো।
বিশেষজ্ঞ মত: অধ্যাপক নাসিমা রউফ (সভাপতি, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন, “কেয়া গাছ ঝোপঝাড়ের অংশ, এখন মানুষ ঝোপ মানেই পরিত্যক্ত ভাবছে। প্রকৃতি তার ছন্দ হারাচ্ছে।”
মাদার: কাঁটার মাঝে সৌন্দর্যের বিস্ময় যেন। মাদার গাছ একসময় জমির সীমানা ঘেরার কাজে ব্যবহার হতো। এর কাঁটা ছিল প্রাকৃতিক বেড়া। আর ফুল? যেন স্বর্গের পারিজাত।
মহাভারতের কাহিনি অনুসারে-দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্গের নন্দন কাননে পারিজাত স্থান পেয়েছিলো। পারিজাত স্বর্গের শোভা হয়ে নিজের ঘ্রাণে মুগ্ধ করতো দেব দেবীদের। পারিজাত গাছটিকে পৃথিবীতে আনেন শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণের দুই স্ত্রী সত্যভামা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগানও পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক। কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করে। যার ফুল রুক্মিণীর বাগানেও ঝরে পড়তো।
বিশেষজ্ঞ মত: অধ্যাপক ড. আনোয়ারা সুলতানা (উদ্ভিদ ও পরিবেশ গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) জানান, “মাদার ফুল অলৌকিক সৌন্দর্যের আধার, তার ঔষধি গুণও আছে। লোককথায় টিকে থাকলেও বাস্তবে বিলুপ্ত।”
বিলুপ্তির কারণসমূহ: ১) নদী ও জলাভূমির দখল এবং দূষণ। ২) উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় গাছ উপেক্ষা ৩) বনাঞ্চল উজাড় করে মনোকালচার রোপণ। ৪) জনসচেতনতার অভাব।
বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব: ১. বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষের জাতীয় তালিকা তৈরি করে সংরক্ষণ অভিযান চালানো। ২. ‘হেরিটেজ ট্রি’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ গাছকে স্বীকৃতি দেয়া। ৩. পাঠ্যবইয়ে স্থানীয় বৃক্ষ ও তাদের পরিবেশগত ভূমিকা অন্তর্ভুক্ত। ৪. স্থানীয় সরকার ও নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে বৃক্ষরোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ।
শেষ কথা: এইসব গাছ হারানো মানে কেবল প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য হারানো নয়, একেকটি কাহিনির, একেকটি জীবনরীতির বিদায়। আমরা যদি এখনই এগিয়ে না আসি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ‘হিজল’ বা ‘কুচ বরণ’ শুধু কবিতার উপমা হিসেবেই রয়ে যাবে, বাস্তবে নয়।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More