আসিফ নজরুলের ‘সেফ এক্সিট’ বিতর্ক: বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ও মানবাধিকার সংকটের বিশ্লেষণ

স্টাফ রিপোর্টার:ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাত্র তিন মাস দূরে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ভোট অনুষ্ঠিত হবে বলে ইতোমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টারা বারবার নিশ্চিত করেছেন। এই পরিস্থিতিতে রাজনীতির মাঠ এখন সম্পূর্ণ নির্বাচনমুখী। দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা জনসংযোগ ও সমাবেশে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ঠিক এমন সময় ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের মন্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।

‘সেফ এক্সিট’: রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড়

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আহ্বায়ক ও সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, অনেক উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ গড়ে নিজেদের ‘সেফ এক্সিট’ বা নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। এই মন্তব্য রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। টেলিভিশন টকশো এবং সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। এমনকি সরকারের মধ্যেও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, নাহিদ ইসলাম এক সময় সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এখন বিরোধী অবস্থানে গেলেও ক্ষমতাসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়ে গেছে। সেই কারণে তার বক্তব্য রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।

আসিফ নজরুলের প্রতিক্রিয়া: ‘সেফ এক্সিট’ নয়, দেশ দরকার ‘সেফ এন্টার’

সেই আলোচনার প্রেক্ষিতে ‘সেফ এক্সিট’ বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘আমাদের উপদেষ্টাদের কোনো ‘সেফ এক্সিট’-এর প্রয়োজন নেই। বরং দেশের মানুষের দরকার ‘সেফ এন্টার’ বা নিরাপদ প্রবেশ পথ, কারণ আমরা দীর্ঘদিন ধ্বংসাত্মক, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গেই লড়ে যাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত ৫৫ বছরে আমরা যে দুঃশাসন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ব্যাংক থেকে সাধারণ মানুষের আমানত লুটের ঘটনা দেখেছি, তা থেকে মুক্তির জন্য আমাদের ‘সেফ এক্সিট’ নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও মানবিক রাষ্ট্র কাঠামোর প্রয়োজন।’

বিচারব্যবস্থা: রাজনৈতিক প্রভাব ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

ড. আসিফ নজরুল উল্লেখ করেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির বিচারপতি নিয়োগে স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কখনই বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছামতো বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন, যা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার স্বতন্ত্রতা ও নিরপেক্ষতায় বড় ধাক্কা।

আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এমন বিচারক পেয়েছি যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও গণতন্ত্রের অবনতিতে তারা ভূমিকা রেখেছেন। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখেও তারা নীরব থেকেছেন, এমন বিচারকদের শাস্তি দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। দুঃখজনকভাবে, এখনও বিচার বিভাগে এমন কিছু ব্যক্তির অবস্থান রয়েছে।’

প্রতিষ্ঠান গঠন ও আইন প্রণয়ন: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা অনেক ভালো আইন প্রণয়ন করেছি, কিন্তু আইন কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। আইন তৈরি করাই যথেষ্ট নয়, প্রতিষ্ঠানের কার্যক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ইতিহাসে আইন প্রণয়নে ব্যর্থতা নেই, কিন্তু প্রতিষ্ঠান গঠনে সীমাহীন ব্যর্থতা রয়েছে।’

তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর মাধ্যমে আমরা একটি শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন গড়ে তুলতে পারব, যা মানবাধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

মানবাধিকার কমিশন ও জবাবদিহিতা: দেশের ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য

আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘ভয়াবহ রাষ্ট্র কাঠামো থেকে উত্তরণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে। এর মধ্যে উচ্চ আদালত, সংসদীয় কমিটি এবং মানবাধিকার কমিশন অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর না হলে দেশের মানুষ যে কোনো সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হতে পারে।’

তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন শুধু সরকারের বা একক ব্যক্তির দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব। সংশোধিত আইনটি কমিশনের দক্ষতা ও স্বাধীনতা আরও বাড়াবে, যা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়ক হবে।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ নিয়ে আলোচনা সভা

১১ অক্টোবর রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ খসড়া বিষয়ক জাতীয় আলোচনা সভায় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ছাড়াও গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, সুইজারল্যান্ড ও ড্যানিশ দূতাবাসের প্রতিনিধিরা, ইউএনডিপি বাংলাদেশের রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ স্টেফান লিলারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের আইন, বিচার ও নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা রোমানা শোয়েগার। এতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, মানবাধিকার সংগঠন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা অংশগ্রহণ করেন।

বিশ্লেষণ: ‘সেফ এক্সিট’ বিতর্কের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার প্রভাব

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘সেফ এক্সিট’ বা নিরাপদ প্রস্থানের প্রশ্নটি নতুন নয়, তবে এটি নির্বাচনের আগে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। সাবেক উপদেষ্টাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ ও নিরাপদ প্রস্থান নিয়ে আলোচনা মানেই একটি সংকটের ইঙ্গিত। এর ফলে রাজনীতিতে অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তা বাড়ে।

অন্যদিকে, আসিফ নজরুলের বক্তব্য দেশের দীর্ঘদিনের বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র সামনে নিয়ে এসেছে। এটি বোঝায় যে, শুধু নির্বাচনের নিরাপত্তা নয়, দেশের বিচার ব্যবস্থা ও মানবাধিকার রক্ষায় মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন।

‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ’ সংশোধনের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে চাইলে তা দেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। এটি শুধু সরকারের কাজ নয়, পুরো সমাজ ও নাগরিকদের অংশগ্রহণ জরুরি।

এই সংবাদ ও বিশ্লেষণ সাধারণ নাগরিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি দেশের বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা দেয়। এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

সূত্র:
– বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
– আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়
– ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল, ঢাকা
– ইউএনডিপি বাংলাদেশ

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More