এসপি স্যারের মতো ভালো মানুষকে আল্লাহ নিশ্চয়ই ভালো রাখবেন

চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলামের বদলির খবরে ব্যথিত বাদাম বিক্রেতা হারুন বিশ্বাস

শামসুজ্জোহা রানা: ‘স্যার খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। উনি চলে যাচ্ছেন! যেখানেই যান আল্লাহ যেনো তাকে ভালো রাখেন। নিজের ছেলেরা যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো তখন তিনিই আমার মাথায় রেখেছিলেন হাত। আমার চশমা, ওষুধ সবই তিনি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, দিয়েছেন প্রয়োজনীয় খরচার জন্য নগদ টাকাও। নিজের এক ছেলে ও দুই মেয়ে থাকতেও যখন আমি একা হয়ে যায় তখন তিনিই কিছুটা হলেও সন্তানের মতো আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন।’ গতকাল রোববার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা জজ কোর্ট এলাকায় এসব বলছিলেন আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন ষাটোর্ধ্ব হারুন বিশ্বাস। কারণ, চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম। হ্যাঁ, এসপি জাহিদুল ইসলামের বদলিই তার মনের বেদনার কারণ। সকালে দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকা দেখে পুলিশ সুপারের বদলির খবরটি জানতে পারেন হারুন। পত্রিকায় পুলিশ সুপারের বিদায় সংবর্ধনার সংবাদ দেখার পর থেকে বিষন্ন মনে ঘুরছেন হারুন বিশ্বাস। ঠিক এসময় তার সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।

চুয়াডাঙ্গার সুমিরদিয়া রেলপাড়ার মৃত শামসুল বিশ্বাসের ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী হারুন বিশ্বাস পেশায় একজন বাদাম বিক্রেতা। পুলিশ সুপারের বদলিতে তার মনোবেদনার কারণ জানার ইচ্ছে হলো খুব। হারুন বিশ্বাস বলেন, আমি কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতাম। ২০২০ সালের প্রথম দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একসাইড প্যারালাইসিস হয়ে যায়। সদর হাসপাতালে সরকারিভাবে কোনোরকম চিকিৎসা হয়। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। আর হ্যাঁ, আমার এক ছেলে দুই মেয়ে রয়েছে। আমি হাসপাতালে ভর্তি থাকাতেই তারা আমার খোঁজখবর নেয়া বন্ধ করে দেয়। আর খোঁজ নেবেই বা কেনো? আমি অচল মানুষ, আমার তো আর কিছুই নেই। ছেলে মেয়ে থেকেও আমি একা হয়ে যায়। যে বাড়িটা ছিলো স্ত্রী মারা যাওয়ার আগেই সেটা ছেলের নামে লিখে দিয়ে গেছে। এখন সেখানে আর আমার জায়গা হয় না। আমার অসহায়ত্ব দেখে চাচাতো ভাইয়ের ছেলে তার কারখানায় থাকার জন্য ব্যবস্থা করে। মাথাগোঁজার ঠাঁই হলেও দুশ্চিন্তা খাওয়ার। অচল মানুষ, কোনো কাজ করার সামর্থ্য আমার নেই। বাধ্য হয়েই ভিক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা ভিক্ষুকমুক্ত। শুনি শহরে ভিক্ষা করতে গেলে নাকি পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। পেটে ক্ষুধা আবার পুলিশেরও ভয়। কোথাও কিছু না পেয়ে এসপির কাছে যায় ভিক্ষা করার লাইসেন্স নিতে। এরপর এসপি স্যারের সাথে দেখা হলো। এসপি জাহিদুল ইসলাম আমার জন্য যা করলেন তাতে নিজের অচল বাবার খোঁজ না রাখা সন্তানদের ভুলে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তখন মনে হচ্ছিলো ছেলেমেয়েরা আমাকে ভুলে গেলেও অন্তত আমার কাঁধে হাত রাখার মতো কেউ আছে। এসপি স্যার সেদিন আমার কাছে সবকিছু শোনার পর ভিক্ষা না করে নিজে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। তার জন্য তিনি আমাকে পাঁচ কেজি বাদাম, ডিজিটাল মেশিন, বাদাম ভাজার জন্য বড় একটা কড়াই ও নগদ দুই হাজার টাকা, চোখে কম দেখায় চশমা ও যাবতীয় ওষুধ কিনে দেন। এখন এই বাদাম বিক্রি করে যা রোজগার হয় তা দিয়ে বাজার করে খায়। এগুলো অন্যদের কাছে সামান্য কিছু হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু। আমার জীবন বদলে দেয়ার চাবি। এসপি জাহিদুল ইসলাম স্যার আমার জন্য যতটুকু করেছেন নিজের সন্তানরা তো সেটুকুও করেনি। শুধু তাই নয়, তারপর থেকে নিজেই নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন এসপি স্যার। প্রায় প্রায় নগদ টাকা পাঠান আমাকে। এসব কথা বলতে বলতে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন হারুন বিশ্বাস। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, এসপি স্যার খুব ভালো একটা মানুষ; আল্লাহ নিশ্চয়ই ওনাকে ভালো রাখবেন।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন জাহিদুল ইসলাম (বিপিএম সেবা)। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কাজ শুরু করেন তিনি। কয়েকদিনের মধ্যেই চুয়াডাঙ্গার সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নেন তিনি। বিশেষ করে কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়া দম্পতিকে উপহার প্রদানের বিষয়টি এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলে। দীর্ঘ প্রায় তিনবছর চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঢাকায় বদলির আদেশপ্রাপ্ত হন। তার এই বদলির খবর শোনার পর প্রায় প্রতিদিনই জেলা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সামাজিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ছুটে যাচ্ছেন প্রিয় পুলিশ সুপারকে একবার দেখতে এবং বিদায় জানাতে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More